প্রিয়দর্শিনী ইন্দিরা গান্ধী স্মরণে
প্রকাশ : 2021-11-02 12:07:02১ | অনলাইন সংস্করণ
নিউজ ডেস্ক
প্রবীর বিকাশ সরকার
-----------------
আমি জাপানের মাটিতে পা রাখার মাত্র ৮ দিনের দিন ১৯৮৪ সালের ৩১ অক্টোবর তারিখে তিনি নিহত হন। মনে হল, উপমহাদেশ একজন যোগ্য প্রহরীকে হারালো। অনেকেই অপছন্দ করেন তাঁকে, কিন্তু রাজনীতি বুঝতেন তিনি। ১৯৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধে তাঁর যে ভূমিকা ছিল তার মূল্যায়ন এখনো হয়নি, এখনো হয়নি গবেষণা। এই মুক্তিযুদ্ধে বিশ্বের সবগুলো পরাশক্তি জড়িয়ে পড়েছিল প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে ছিল একমাত্র সোভিয়েত রাশিয়া তাঁরই কূটনীতির কারণে। ফ্রান্স ও ব্রিটেন আড়ালে সমর্থন দিলেও প্রকাশ্যে ছিল চীন ও আমেরিকা। কিন্তু দমে যাননি, ভয়ও পাননি প্রিয়দর্শিনী ইন্দিরা গান্ধী। পাকিস্তান, আমেরিকা ও চীনকে নাকানি-চোবানি খাইয়েছিলেন এই দুঃসাহসী, দূরদর্শী নারী রাজনীতিবিদ। তাঁর রাজনৈতিক জীবনে ১৯৭১ ঐতিহাসিকভাবে একটি সাফল্যজনক ঘটনা, বিশ্বইতিহাসে একটি মাইলফলক। বিশ্বদরবারে আজও তাঁর সম্মান ক্ষুণ্ণ হয়নি এতটুকু।
আমার ছাত্রজীবনের ঘটনা, এখনো মনে আছে সুস্পষ্টভাবে, ভারত থেকে ফিরে এসে ছত্রভঙ্গ, বিধ্বস্ত আওয়ামী লীগের হাল ধরেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। তিনি অত্যন্ত শ্রদ্ধা করতেন ইন্দিরা গান্ধীকে। সম্ভবত ১৯৮৩ বা ১৯৮৪ সালে প্রকাশিত কলকাতার সাপ্তাহিক প্রতীক্ষণ ম্যাগাজিনে প্রকাশিত একটি বিশেষ সাক্ষাৎকারে তিনি মিসেস ইন্দিরা গান্ধীকে মায়ের চোখে দেখেন বলে মন্তব্য করেছিলেন। ইন্দিরা গান্ধী বেঁচে থাকলে শেখ হাসিনার জন্য অনেক ভালো হতো। পিতৃহারা শেখ হাসিনাকে গাইড করতেন সন্দেহ নেই।
জাপান-ভারত সম্পর্ক একটি পরীক্ষিত বন্ধুত্বের সাক্ষর। প্রধান মন্ত্রী হওয়ার আগে-পরে ইন্দিরা গান্ধী একাধিকবার জাপান ভ্রমণ করেন। প্রথম ভ্রমণে আসেন পিতা নেহরুসহ ১৯৫৭ সালে। এটা দুজনের জন্যই প্রথম জাপান সফর। তখন তাঁর বয়স ৪০। সুন্দরী ইন্দিরা জাপানি নাগরিকদের বিশেষ নজর কেড়েছিলেন। জাপানি রাজনীতি এবং সাংস্কৃতিক জগতে তাঁর উচ্চাসন ছিল যতদিন বেঁচেছিলেন। জাপানের জাঁদরেল রাজনীতিবিদরা তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করার জন্য ভারতে ছুটে গেছেন। এই দেশে তাঁর পিতা নেহরুর জনপ্রিয়তা ছিল তুঙ্গে নানা কারণেই। তার মধ্যে দুটি কারণ অবশ্যই উল্লেখ্য:
১. দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপান পরাজিত হওয়ার পর মিত্রশক্তি প্রধান আমেরিকার সঙ্গে শান্তিচুক্তি স্থাপিত হয় ১৯৫২ সালে সানফ্রান্সিসকো শহরে। এই শান্তি স্মারক চুক্তিতে ভারতের প্রধান মন্ত্রী হিসেবে নেহরুকে আহবান করা হয়েছিল সংশ্লিষ্ট অন্যান্য দেশের সঙ্গে। কিন্তু নেহরু তাতে সম্মত হননি, তিনি আলাদাভাবে ভারত-জাপান শান্তিচুক্তি করেছিলেন। এটা নেহরু করেছিলেন পরোক্ষভাবে জাপানের প্রতি কৃতজ্ঞতাস্বরূপ, কারণ জাপানের সহযোগিতার জন্যই ভারত স্বাধীনতা তরান্বিত এবং সম্ভব হয়েছিল। যদিও প্রকাশ্যে রাষ্ট্রীয়ভাবে ভারত সেই স্বীকৃতি দিতে বিলম্ব করছে আজও।
২. যুদ্ধবিধ্বস্ত জাপানের শিশুদের সামনে যখন কোনো আলো নেই, শক্তিশালী হওয়ার মতো কোনো উদাহরণ নেই, তখন জাপানি চিন্তবিদরা ভাবলেন, শিশুদের মধ্যে মানসিক ও শারীরিক শক্তি জাগিয়ে তোলার জন্য হাতি হতে পারে একটি মোক্ষম দৃষ্টান্ত। কারণ জাপানে হাতি নেই। কিন্তু জাপানি শিশুরা হাতি খুবই পছন্দ করে। সেই চিন্তা থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা প্রধান মন্ত্রী নেহরুকে চিঠি লিখে আবেদন জানায়। শিশুপ্রিয় নেহরু সেই আবেদনে সাড়া দিয়ে একটি তরুণ হস্তিনী যার নাম “ইন্দিরা” জাপানি শিশুদেরকে উপহার হিসেবে প্রেরণ করেন। জাহাজে করে সেই ইন্দিরা জাপানে আগমন করে হাজার হাজার মাইল দূরের দেশ ভারতবর্ষ থেকে।
সেই ইন্দিরাকে নেহরু প্রথম জাপান সফরের সময় রাজধানী টোকিওর কেন্দ্রিয় উয়েনো চিড়িয়াখানায় একটি বিশেষ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে কর্তৃপক্ষের কাছে অর্পণ করেন। কী ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছিল সারা জাপানে তখনকার পত্রপত্রিকায় তার অনেক ছবি ও সংবাদ রয়েছে। কী আনন্দ জাপানি শিশুদের চোখেমুখে তার আলোকচিত্র দেখার সৌভাগ্য হয়েছে আমার গ্রন্থাগারে।
ভারতীয় সেই হাতি “ইন্দিরা” যতদিন জীবিত ছিল জাপানে অভাবনীয় জনপ্রিয় প্রাণী ছিল, ভালোবাসা ও দুই দেশের বুন্ধত্বের আইকনে পরিণত হয়েছিল। শুধু শিশুরাই নয়, সব বয়সী নাগরিকরা সারা জাপান থেকে এসে হুমড়ি খেয়ে পড়েছিলেন উয়েনো চিড়িয়াখানায়। আমিও জাপানে একাধিকবার “ইন্দিরা”কে দেখতে গিয়েছি স্ত্রীর আগ্রহের কারণে। মেয়ে টিনার শৈশবেও তাকে নিয়ে গেছি একাধিকবার। চোখের সামনে বিশাল হাতি দেখে তার চোখে সে কি আনন্দ এবং বিস্ময় আমি লক্ষ করেছিলাম!
এই কারণে নেহরু-কন্যা পরবর্তীকালে প্রধান মন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর ব্যাপক জনপ্রিয়তা ছিল জাপানে। মনে আছে, ১৯৯৯ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নিয়ে গবেষণার জন্য দলিলপত্র অনুসন্ধান করতে গিয়েছিলাম য়োকোহামা বন্দরনগরীর বিখ্যাত ওওকুরায়ামা স্মারক ভবনে। সেখানে অনেক মুদ্রিত পত্রপত্রিকা, তথ্য-উপাত্ত খুঁজে পাই। এর মধ্যে “টেগোর মেমোরিয়াল অ্যাসোসিয়েশন” এর একটি বুলেটিনে জানতে পারি, ১৯৫৭ সালে যখন জাপানে কবিগুরুর জন্মশতবর্ষ উদযাপন উপলক্ষে কতিপয় বুদ্ধিজীবী একটি আলোচনা সভার আয়োজন করেন, তাতে উপস্থিত ছিলেন ইন্দিরা গান্ধী। কাকতালীয় ঘটনা বলতেই হবে। ইন্দিরা গান্ধী একসময় শান্তিনিকেতনের ছাত্রী ছিলেন। রবিঠাকুর ছিলেন তাঁর গুরুদেব। সেই গুরুদেবই যেন তাঁর প্রিয় ছাত্রীর সঙ্গে সংযোগ ঘটিয়ে দিয়েছিলেন জাপানে তাঁর জন্মশতবর্ষ উদযাপন প্রস্তুতির শুভসূচনায়। আমার তাই মনে হয়েছিল তাৎক্ষণিকভাবে ওওকুরায়ামা ভবনে বসে।
১৯৫৭ সালের সেই সময়ই আরেকটি ঘটনা ঘটে টোকিওর সুগিনামি-ওয়ার্ডে অবস্থিত রেনকোওজি বৌদ্ধ মন্দিরে, যেখানে নেহরুর আজীবন প্রতিদ্বন্দ্বী নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর চিতাভস্ম সংরক্ষিত আছে। নেতাজির প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করার জন্য প্রধান মন্ত্রী নেহরু মন্দিরে উপস্থিত হয়েছিলেন। তাঁর সঙ্গে ছিলেন কন্যা ইন্দিরা গান্ধীও। এর ঠিক পরে দশ বছরের মাথায় তিনি ভারতের প্রথম নারী প্রধান মন্ত্রী হওয়ার গৌরব অর্জন করেন, বাকিটা তো ইতিহাস।
তাঁর মৃত্যু দিবসে গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি।