প্রাণীকূল ধ্বংসের মূলে প্লাস্টিক

প্রকাশ : 2022-10-08 14:32:26১ |  অনলাইন সংস্করণ

  নিউজ ডেস্ক   

প্রাণীকূল ধ্বংসের মূলে প্লাস্টিক

প্লাস্টিক দূষণ হল পরিবেশ কর্তৃক প্লাস্টিক পদার্থের আহরণ যা পরবর্তীতে যে বন্যপ্রাণ, বন্যপ্রাণ আবাসস্থল, এমনকি মানবজাতীর ওপর বিরূপ প্রভাব সৃষ্টি করে৷ আকারের উপর ভিত্তি করে, মাইক্রো-, মেসো-, অথবা ম্যাক্রোবর্জ্য এই তিনভাগে প্লাস্টিক দূষণকে শ্রেণীকরণ করা হয়। নিয়মিত প্লাস্টিক পদার্থের ব্যবহার প্লাস্টিক দূষণের মাত্রাকে বাড়িয়ে দিচ্ছে৷ পলিথিন ব্যাগ, কসমেটিক প্লাস্টিক, গৃহস্থালির প্লাস্টিক, বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহৃত প্লাস্টিক পণ্যের বেশিরভাগই পুনঃচক্রায়ন হয় না৷ এগুলো পরিবেশে থেকে বর্জ্যের আকার নেয়৷ মানুষের অসচেতনতাই প্লাস্টিক দূষণের প্রধান কারণ ৷ প্লাস্টিক এমন এক রাসায়নিক পদার্থ যা পরিবেশে পচতে অথবা কারখানায় পুনঃপ্রক্রিয়াকরণ করতে প্রচুর সময় লাগে ৷ তাই একে "অপচ্য পদার্থ" হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়। তাই প্লাস্টিক বর্জ্য পরিবেশে দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতিকর প্রভাব সৃষ্টি করে ৷ সাধারনত উদ্ভিদকূল, জলজ প্রাণী, দ্বীপ অঞ্চলের প্রাণীরা প্লাস্টিক বর্জ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে৷ প্লাস্টিক বর্জ্য ঐসকল প্রাণীর বাসস্থান, খাদ্য সংগ্রহের স্থান ও উদ্ভিদের খাদ্য গ্রহণের পথে বাধার সৃষ্টি করে। শুধুমাত্র উদ্ভিদ বা জলজ প্রাণী নয়, মানুষ প্লাস্টিক দূষণের কারণে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ৷ থাইরয়েড হরমোনের অতিরিক্ত ক্ষরণের জন্য প্লাস্টিক দূষণ পরোক্ষভাবে দায়ী৷ শুধুমাত্র আমেরিকাতে প্রতিবছর ৫ মিলিয়ন টন প্লাস্টিক পণ্য ব্যবহৃত হয় ৷ এগুলোর মধ্যে মাত্র ২৪ শতাংশ পুনঃচক্রায়ন হয়ে থাকে ৷ অন্য ৩.৮ মিলিয়ন টন প্লাস্টিক বর্জ্য আকারে মাটিতে ফেলে দেওয়া হয়৷ বর্তমানে বিভিন্ন দেশে প্লাস্টিক পণ্যের ব্যবহার কমাতে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে ৷ বাংলাদেশেও পলিথিন ব্যাগ ব্যবহারের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।

সাধারণত প্লাস্টিক দূষণের জন্য দুই ধরনের প্লাস্টিক দায়ী: মাইক্রোপ্লাস্টিক (ক্ষুদ্রপ্লাস্টিক) যা সাধারণত মেগা বা বৃহত হিসেবে পরিগণিত এবং ম্যাক্রো-প্লাস্টিক। উত্তর গোলার্ধে শহুরে কেন্দ্র ও জল সম্মুখভাগে মেগা ও মাইক্রোপ্লাস্টিক সর্বোচ্চ ঘনত্বের মধ্যে প্রায় ঘনীভূত অবস্থায় সঞ্চিত রয়েছে।

প্লাস্টিক বর্জ্য প্রাথমিক বা মাধ্যমিক হিসাবেও শ্রেণীকরণ করা হয়ে থাকে। প্রাথমিক প্লাস্টিক সংগ্রহের সময় তাদের মূল গাঠনিক অবস্থায় বিদ্যমান থাকে। উদাহরণ সরূপ বোতলের ঢাকনা, সিগারেট বাট, এবং মাইক্রোবর্জ্য।

যেসকল প্লাস্টিক বর্জ্যের আকার ২ µm থেকে ৫ মিমি-এর মধ্যে, সেসকল প্লাস্টিক বর্জ্যকে মাইক্রোবর্জ্য বলা হয়৷ মেসো ও ম্যাক্রো বর্জ্যকে ভাঙন ও পেষণের মাধ্যমে মাইক্রোবর্জ্যে পরিণত করা যায় ৷ মাইক্রোবর্জ্য সাধারণত নারডল নামে পরিচিত৷ নারডল দ্বারা নতুন প্লাস্টিক পণ্য তৈরি করা হয়ে থাকে৷, কিন্তু ক্ষুদ্র আকারের কারণে এগুলো দ্রুত পরিবেশের সাথে মিশে যেতে পারে৷ মাইক্রোবর্জ্যের ক্ষুদ্র আকারের কারণে ফিল্টার ফিডিং জীব এগুলো গ্রহণ করে৷ ২০০৪ সালে যুক্তরাজ্যের প্লাইমাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের রিচার্ড থম্পসন গবেষণার মাধ্যমে ইউরোপ, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, এন্টার্কটিকা অঞ্চলের সাগরের জলে প্রচুর পরিমাণে মাইক্রোবর্জ্য খুঁজে পান। থম্পসন ও তার সহযোগীরা ঐ অঞ্চলের পানিতে গৃহস্থালি ও বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহৃত প্লাস্টিকের ভাঙ্গা অংশ খুঁজে পান, যার কিছু মানুষের চুলের থেকেও ক্ষুদ্র৷ থম্পসন সেখানকার সমুদ্র পৃষ্ঠের থেকে সম্ভবত ৩,০০,০০০ প্লাস্টিক উপাদান/কিমি২ এবং সমুদ্রতলদেশ থেকে ১০০,০০০ প্লাস্টিক কণা/কিমি২ মাইক্রো প্লাস্টিক বর্জ্য পান।

সাধারনত ২০ মিমি আকারের চেয়ে দীর্ঘ হলে তাদের ম্যাক্রোবর্জ্য বলা হয়। এগুলোর মধ্যে প্লাস্টিক মুদি থলে অন্যতম৷ ম্যাক্রোবর্জ্য প্রায়ই সমুদ্রের জলের মধ্যে পাওয়া যায় যা সামুদ্রিক জীবের জন্য ক্ষতিকর প্রভাব সৃষ্টি করে৷ এতে প্রধানত মাছ ধরার জাল দূষণ হয়ে থাকে।

প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপত্তির স্থান থেকে বিভিন্ন উপায়ে ভিন্ন ভিন্ন আকারে পরিবেশে ছড়িয়ে পড়ে ৷ সমুদ্র স্রোত, বাতাসের অসম গতি, ভৌগোলিক বৈচিত্রতার কারণে প্লাস্টিক বর্জ্য বিভিন্ন উপায়ে ছড়িয়ে পড়ছে ৷ ক্যারিবিয়ান সমুদ্র অঞ্চলে গেলে তা ভালভাবে উপলব্ধি করা যায় ৷ ঐসব অঞ্চলে সাধারণত মাইক্রো ও ম্যাক্রো আকারের প্লাস্টিক বর্জ্য পাওয়া যায় ৷ যেহেতু প্লাস্টিক অপচ্য পদার্থ , তাই সৃষ্টির পর পুনঃচক্রায়ন না হওয়া পর্যন্ত এটি পরিবেশে অবস্থান করে ৷ এটি নিয়মিত প্রাণীর খাদ্যচক্রে ঢুকে পড়ছে (মাইক্রো কণাসমূহ) ,যা প্রাণীর জন্য খুবই বিপদজনক ৷ বিভিন্ন উপায়ে প্লাস্টিক বর্জ্য পরিবেশের ভারসম্যকে নষ্ট করছে৷

ক্লোরিনযুক্ত প্লাস্টিক বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ নির্গত করে যা ভূগর্ভস্থ পানি ও ভূপৃষ্ঠীয় পানির সাথে মিশে যায়৷ অতঃপর ভূগর্ভস্থ ও ভূপৃষ্ঠীয় পানি গ্রহণের সাথে সাথে তা আমাদের খাদ্যচক্রে ঢুকে পড়ে ৷ কারণ এটির মাটিতে পচতে সময় লাগে ৪০০ বছর। আর এভাবেই পানি গ্রহণের সাথে সাথে প্রতিনিয়ত আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি ৷ [৭] মাটিতে বিভিন্ন ধরনের অনুজীব বাস করে যা প্লাস্টিক অণুর ভাঙনে সাহায্য করে ৷ এইসকল অণুজীবের মধ্য "সিউডোমোনাস( Pseudomonas)" , "নাইলন খাদক ব্যাকটেরিয়া (nylon-eating bacteria)" , " ফ্লাভো ব্যাকটেরিয়া ( Flavobacteria) অন্যতম ৷ এইসকল ব্যাকটেরিয়া "নাইলোনেজ" এনজাইম ক্ষরণের মাধ্যমে নাইলন অণুকে ভেঙ্গে ফেলে ৷ জীবাণুবিয়োজ্য প্লাস্টিক ভাঙনের মাধ্যমে মিথেন গ্যাস উৎপন্ন হয় ৷ মিথেন এক প্রকার গ্রীণহাউজ গ্যাস ৷ এটি বৈশ্বিক উষ্ণায়নের জন্য দায়ী ৷

২০১২ সালে, গবেষণার মাধ্যেমে জানানো হয় যে, সমগ্র বিশ্বের সমুদ্রে আনুমানিক ১৬৫ মিলিয়ন টন প্লাস্টিক বর্জ্য আছে ৷ "নারডল" নামক এক প্রকার প্লাস্টিক যা সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে ৷ এটি এমনই এক শিল্পজাত প্লাস্টিক যা প্লাস্টিক পণ্য বা কার্গো শীপ তৈরীতে ব্যবহৃত হয় ৷ প্রচুর পরিমাণে নারডল সমুদ্রের পানিতে পতিত হয় ৷ বছর বছর এই প্লাস্টিক পদার্থের পরিমাণ বেড়েই চলেছে ৷ এর ফলে প্লাস্টিক থেকে প্রতিনিয়ত ক্ষতিকর রাষায়নিক পদার্থ যেমন: বায়োস ফেনল, পলিস্টিরিন ইত্যাদি পরিস্রুত হয়। এক পরিসংখ্যানে জানা যায় যে, সমুদ্রের পানিতে ৫ ট্রিলিয়নের বেশি প্লাস্টিক ভেসে থাকে ৷ আমাদের মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সিতে যে পরিমাণ তারা আছে, সুমুদ্রে তার থেকেও বেশি৷ মিলিয়ন টনের বেশি প্লাস্টিক প্রতিবছর সুমুদ্রে জমা হচ্ছে৷

   

প্লাস্টিক দূষণ প্রাণীকুলের খাদ্যচক্রের উপর বিরূপ প্রভাব সৃষ্টি করে ৷ এটি সামুদ্রিক স্তন্যপায়ী প্রাণীর উপর বেশি বিরুপ ফেলে ৷ " Introduction to Marine Biology" বই অনুসারে প্লাস্টিক দূষণ সামুদ্রিক প্রাণীর জন্য "একক সর্বাধিক হুমকি" র মত ৷ বেশকিছু সামুদ্রিক প্রজাতি, যেমন: সামুদ্রিক কচ্ছপের পাকস্থলীতে বিজ্ঞানিরা প্রচুর পরিমাণে প্লাস্টিক বর্জ্য পেয়েছেন ৷ যখনই এমনটা ঘটে, তখন ঐসব প্রাণী ক্ষুধায় ভোগে কারণ প্লাস্টিক বর্জ্য তাদের পরিপাকতন্ত্রকে বন্ধ করে দেয় ৷ এতে প্রাণীর মৃত্যুও ঘটে ৷ অনেকক্ষেত্রে, সামুদ্রিক প্রাণী প্লাস্টিক পণ্য যেমন জাল দ্বারা বিজড়িত হয় ৷ যার কারণে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হয় ও মৃত্যুও ঘটে থাকে ৷

সামুদ্রিক প্রাণীর উপর প্লাস্টিক দূষণের প্রভাব সবচেয়ে বেশি ৷ সামুদ্রিক কচ্ছপের মৃত্যু প্লাস্টিক দূষণের কারণে ঘটছে ৷ সামুদ্রিক কচ্ছপ সাধারণত জেলিফিশ, সামুদ্রিক কীট খেয়ে জীবনধারণ করে ৷ জেলিফিসের আকার ও আকৃতি প্লাস্টিক ব্যাগের মত হওয়ায় কচ্ছপ ভুল করে প্লাস্টিক ব্যাগ ভক্ষণ করে ৷ এতে তাদের খাদ্য নালিকা বন্ধ হয়ে যায় এবং খাদ্য গ্রহণ করতে অক্ষম হওয়ায় ধীরে ধীরে মারা যায় ৷ এর চেয়েও বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় সামুদ্রিক তিমি ৷ সামুদ্রিক তিমির পাকস্থলীতে প্রচুর পরিমাণে প্লাস্টিক পাওয়া গিয়েছে ৷ এছাড়াও সামুদ্রিক ছোট মাছের পাকস্থলীতে প্লাস্টিক পাওয়া গিয়েছে ৷ তাই প্লাস্টিক দূষণ সামুদ্রিক মৎস্য প্রজাতির জন্য হুমকিস্বরূপ।

প্লাস্টিক দূষণের প্রভাব শুধুমাত্র সামুদ্রিক মাছের উপর নয় সামুদ্রিক পাখির উপরও রয়েছে ৷ বেশিরভাগ সামুদ্রিক পাখির পেটে প্রচুর পরিমাণে প্লাস্টিক পাওয়া যায় ৷ কারণ সমুদ্রে ভাসমান প্লাস্টিক ও মাছের মধ্য তুলনা না করতে পারায় পাখিরা প্লাস্টিক গ্রহণ করে ৷ ২০০৪ সালে এক গবেষণায় মাধ্যমে গবেষকরা জানান "সামুদ্রিক গিল" এর পেটে ৩০ খন্ডের সম পরিমাণ প্লাস্টিক পাওয়া যায় ৷ প্লাস্টিক পদার্থ থেকে সাধারণত বিষাক্ত রাসায়নিক পলিক্লোরিনেটেড বায়োফেনল নির্গত হয় ৷ এই বিষাক্ত রাষায়নিক দেহের বিভিন্ন টিস্যুকে ক্ষতিগ্রস্ত করে ৷ পাখিরা যখন প্লাস্টিক পদার্থ গ্রহণ করে তখন তাদের পেটেও বিষাক্ত রাষায়নিক পলিক্লোরিনেটেড বায়োফেনল নির্গত হয় ৷ এর জন্য তাদের দেহের টিস্যু ধ্বংস হয়, তাদের দেহের প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায় ৷ ধীরে ধীরে পাখির মৃত্যু হয় ৷ এক পরিসংখ্যানের মাধ্যমে জানা যায় যে, ১.৫ মিলিয়ন লাইসন অ্যালবাট্রস যারা উত্তর ক্যরোলাইনে বাস করে তাদের পাকস্থলিতে প্লাস্টিক পদার্থ পাওয়া যায় এবং তাদের মৃত্যু ঘটে ৷

প্লাস্টিক দূষণ মানুষের স্বাস্থ্যের উপর ব্যাপক প্রভাব ফেলে। সাধারনত প্লাস্টিক পদার্থে প্রচুর পরিমাণে রাসায়নিক রঞ্জক মেশানো হয়। এসকল রঞ্জক কারসিনজেন হিসেবে কাজ করে ও এন্ডোক্রিনকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। ২০২২ সালের মার্চে প্রকাশিত এক গবেষণা ফলাফলে প্রথমবারের মতো মানুষের রক্তে মাইক্রোপ্লাস্টিক দূষণ শনাক্ত হয়। এই গবেষণায় অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে ৮০ শতাংশ মানুষের রক্তে এই ক্ষুদ্র কণা পায় বিজ্ঞানীরা। গবেষণা প্রতিবেদনটি এনভায়রনমেন্ট ইন্টারন্যাশনাল জার্নালে প্রকাশিত হয়।[উইকিপিডিয়]