প্রতারণার মাধ্যমে ডায়ানার সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন বিবিসির সাংবাদিক

প্রকাশ : 2021-05-21 09:41:41১ |  অনলাইন সংস্করণ

  নিউজ ডেস্ক   

প্রতারণার মাধ্যমে ডায়ানার সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন বিবিসির সাংবাদিক

বিবিসির তুমুল জনপ্রিয় অনুসন্ধানী অনুষ্ঠান প্যানোরমা। ১৯৯৫ সালে তাতেই অংশ নিয়েছিলেন প্রিন্সেস অব ওয়েলস ডায়ানা। বিখ্যাত সাংবাদিক মার্টিন বশিরকে দেওয়া তাঁর সাক্ষাৎকারটি ওই সময় বিশ্বজুড়ে আলোড়ন তুলেছিল। সাক্ষাৎকারে ব্যক্তি ও দাম্পত্যজীবন এবং রাজপরিবার নিয়ে ডায়ানার অকপট ভাষ্য যতটা না শোরগোল ফেলেছিল, ততটাই বিতর্কের জন্ম দিয়েছিল সাক্ষাৎকার পেতে সাংবাদিক বশিরের প্রতারণার আশ্রয় নেওয়ার অভিযোগ। অভিযোগ তুলেছিলেন খোদ ডায়ানার ভাই আর্ল স্পেনসার।

তারপর এত দিনে টেমস নদীতে অনেক জল গড়িয়েছে। ওই সাক্ষাৎকারের ২৬ বছর পরে এসে সুপ্রিম কোর্টের সাবেক বিচারপতি লর্ড ডাইসনের স্বাধীন তদন্তে সাংবাদিক বশিরের ‘প্রতারণার আশ্রয় নেওয়ার’ নেওয়ার সত্যতা মিলেছে। আরও বলা হয়েছে, নব্বইয়ের দশকে এসব অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে বিবিসির অভ্যন্তরীণ অনুসন্ধান ‘দুর্ভাগ্যজনকভাবে অকার্যকর’ ছিল। এর জেরে ক্ষমা চেয়েছে বিবিসি ও সাংবাদিক বশির। বিবিসি গতকাল বৃহস্পতিবার এক বিশদ প্রতিবেদনে তুলে ধরেছে সেই সাক্ষাৎকার আর তদন্তের গল্প।

আলোচিত সাক্ষাৎকার:
১৯৯৫ সালের ২০ নভেম্বর বিবিসিতে প্রচারিত হয়েছিল ডায়ানার আলোচিত সেই সাক্ষাৎকার। ওই সময় ২ কোটি ৩০ লাখ ব্রিটিশ নাগরিক টিভির পর্দায় সাক্ষাৎকারটি দেখেন। যা ছিল ওই সময় ব্রিটেনের জনসংখ্যার ৩৯ দশমিক ৩ শতাংশ। সেই সাক্ষাৎকারের পরতে পরতে সাংবাদিক বশিরকে কষ্টের গল্প শুনিয়েছিলেন ডায়ানা।

সাক্ষাৎকারে মা-বাবার বিবাহবিচ্ছেদ থেকে শুরু করে তাঁর বেড়ে ওঠা, বিয়ে, সাধারণ পরিবার থেকে উঠে এসে রাজপরিবারের একজন সদস্য হয়ে ওঠার একাকী লড়াই, প্রিন্স চার্লসের সঙ্গে দাম্পত্য জীবনের কষ্ট ও বঞ্চনা, মাতৃত্বকালীন ঝড়ঝাপটা, অবসাদ প্রভৃতি নানা বিষয়ে অকপট ছিলেন ডায়ানা। উঠে এসেছিল রাজপরিবারের অভ্যন্তরীণ নানা বঞ্চনা ও অন্যায়ের গল্প।

সাক্ষাৎকারটি যখন প্রচারিত হয়েছিল, তখনো ডায়ানা-চার্লসের বিবাহবিচ্ছেদ হয়নি। তবে তখন তাঁরা আলাদা থাকছিলেন। দাম্পত্য জীবনের বঞ্চনা নিয়ে ডায়ানা বলেছিলেন, ‘আমাদের বিয়েতে আমরা লোক ছিলাম তিনজন।’ এর মধ্য দিয়ে প্রথমবারের মতো চার্লস ও ক্যামিলা পার্কারের সম্পর্ক নিয়ে প্রকাশ্যে কথা বলেছিলেন তিনি। শুনিয়েছিলেন নিঃসঙ্গতা ও অবসাদের কারণে নিজের ওপর অত্যাচার করার, আত্মহত্যার চেষ্টার গল্প। ডায়ানার ওই সাক্ষাৎকারে বিশ্ববাসীর সামনে ব্রিটিশ রাজতন্ত্রের জৌলুশপূর্ণ জীবনের আড়ালে প্রাসাদে নারীদের অবর্ণনীয় কষ্টের গল্প প্রকাশিত হয়ে পড়ে।

ওই সাক্ষাৎকার প্রচারের পরের বছরই বিবাহবিচ্ছেদ হয় ডায়ানার। তারও এক বছর পর প্যারিসে এক রহস্যময় সড়ক দুর্ঘটনায় মাত্র ৩৬ বছর বয়সে মারা যান বিশ্ববাসীর কাছে তুমুল জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব প্রিন্সেস ডায়ানা। রহস্যময় সেই দুর্ঘটনা ও তাঁর মৃত্যুর পেছনে বিবিসি প্যানোরমার ওই সাক্ষাৎকার অন্যতম অনুঘটক ছিল বলে অভিযোগ করেন অনেকেই।

বশিরের বিরুদ্ধে অভিযোগ:
বিবিসির অনুসন্ধানী অনুষ্ঠান প্যানোরমায় সাক্ষাৎকারটি প্রচারের পর পরই বিতর্কের ঝড় ওঠে। ডায়ানার ভাই আর্ল স্পেনসার অভিযোগ তোলেন, সাংবাদিক বশির তাঁকে ডায়ানা সম্পর্কিত ব্যাংক অ্যাকাউন্টের কিছু ভুয়া নথি দেখিয়েছিলেন। তাতে বলা হয়েছিল, রাজপ্রাসাদের দু'জন ঊর্ধ্বতন কর্মচারী ডায়ানার ব্যাপারে তথ্য দেওয়ার বিনিময়ে নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর কাছ থেকে অর্থ পাচ্ছেন।

আর্ল স্পেনসারের অভিযোগ, এর মাধ্যমে তিনি (বশির) তাঁর সহানুভূতি আদায় করেছিলেন। যার পরিপ্রেক্ষিতে তিনি বশিরকে ডায়ানার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। যা ডায়ানার সাক্ষাৎকার পেতে বশিরকে সহায়তা করেছিল। বিবিসির মহাপরিচালক টিম ডেভিকে চিঠি দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে এসব অভিযোগ জানিয়েছিলেন স্পেনসার।

ওই সময় স্পেনসার বলেছিলেন, ‘আমি যদি ওই নথিগুলো না দেখতাম তাহলে আমি আমার বোনের সঙ্গে বশিরের পরিচয় করিয়ে দিতাম না।’

আর্ল স্পেনসারের দাবি, সাংবাদিক বশিরের লক্ষ্য ছিল তাঁর আস্থা অর্জন করা ও এর মাধ্যমে ডায়ানার কাছে পৌঁছাতে পারা এবং সাক্ষাৎকারের জন্য ডায়ানাকে রাজি করানো। এ জন্য রাজ প্রসাদে ডায়ানার ব্যক্তিগত চিঠিপত্র খুলে দেখা হচ্ছে, ডায়ানার দেহরক্ষী তাঁর এবং তাঁর বন্ধুদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে এবং ডায়ানার বিষয়ে নানা গল্প সংবাদমাধ্যমকে জানিয়ে দিচ্ছে, ডায়ানার গাড়িকে অনুসরণ করা হচ্ছে এবং ফোন ট্যাপ করা হচ্ছে- এমন নানা প্রতারণামূলক গল্প ফেঁদেছিলেন বশির।

তদন্তে যা উঠে এসেছে:
স্বাধীন তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সাক্ষাৎকার পাওয়ার জন্য ডায়ানার আস্থা অর্জনে প্রতারণার আশ্রয় নিয়েছিলেন সাংবাদিক বশির। তিনি স্পেনসারকে বেশ কিছু ভুয়া নথি দেখিয়েছিলেন। যা ডায়ানার কাছাকাছি যেতে ও তাঁর আস্থা অর্জন করতে বশিরকে সাহায্য করেছিল। আর এ কারণেই ডায়ানা সাক্ষাৎকারে বশিরকে অকপটে তাঁর জীবনের অজানা গল্প শুনিয়েছিলেন। লর্ড ডাইসন বলছেন, সাংবাদিক বশিরের এসব কর্মকাণ্ড ছিল ‘অবিশ্বাস্য, অবিশ্বস্ত ও কিছু ক্ষেত্রে অসৎ’।

তদন্তে আরও বলা হয়েছে, এসব অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৯৬ সালে বিবিসির নিজস্ব অনুসন্ধান ‘দুর্ভাগ্যজনকভাবে অকার্যকর’ প্রমাণিত হয়েছে। যা প্রতিষ্ঠানটির সততা এবং স্বচ্ছতা বজায় রাখার উচ্চ মূল্যবোধকে খাটো করেছে।

যা বলছেন অভিযুক্তরা:
লর্ড ডাইসনের তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশের পর ক্ষমা চেয়েছে বিবিসি ও সাংবাদিক বশির। বিবিসি বলেছে, এ প্রতিবেদন ‘পরিষ্কার ব্যর্থতার’ বার্তা দেয়। ওই সময় কি ঘটেছিল, তা গভীরে গিয়ে খুঁজে দেখতে আরও উদ্যোগ নেওয়ার ও স্বচ্ছতা প্রদর্শনের প্রয়োজন ছিল।

টিম ডেভি বলেছেন, আমরা (বিবিসি কর্তৃপক্ষ) এ জন্য আন্তরিকভাবে দুঃখিত। লর্ড ডাইসন সত্যিকারের ব্যর্থতার স্বরূপ খুঁজে পেয়েছেন। যদিও আমরা ২৫ বছর আগে ফিরে যেতে পারব না, তবে আমরা অবশ্যই শর্তহীন ক্ষমা চাইতে পারি।

বিবিসি করপোরেশনের চেয়ারম্যান রিচার্ড শার্প বলেছেন, বিবিসি খোলাখুলিভাবে স্বীকার করছে, ডাইসনের তদন্ত প্রতিবেদনে ‘অগ্রহণযোগ্য ব্যর্থতার’ চিত্র উঠে এসেছে। 

ঐতিহাসিক এসব বিষয় আমাদের স্বস্তি দিচ্ছে না।
এদিকে এক বিবৃতিতে সাংবাদিক মার্টিন বশির বলেছেন, তিনি ওই সব নথি নিয়ে হাস্যরসের জন্য ক্ষমাপ্রার্থী। তবে তিনি প্রিন্সেস ডায়ানার ওই সাক্ষাৎকার নিতে পেরে ভীষণ গর্বিত হওয়ার কথা জানিয়েছেন। বলেছেন, ওই ব্যাংকিং নথি এমন কিছু বহন করেনি যেটা তাঁর (ডায়ানার) সাক্ষাৎকারে অংশ নেওয়ার ইচ্ছাকে প্রভাবিত করতে পারে।

৫৮ বছর বয়সী মার্টিন বশির যুক্তরাজ্যের অন্যতম প্রখ্যাত সাংবাদিক। ডায়ানা ছাড়াও ২০০৩ সালে তাঁর নেওয়া মাইকেল জ্যাকসনের একটি সাক্ষাৎকার তুমুল আলোচিত হয়েছিল। সম্প্রতি তিনি করোনায় আক্রান্ত হয়েছিলেন। অসুস্থতার কারণে গত সপ্তাহে তিনি বিবিসি ছেড়েছেন। ২০১৬ সাল থেকে তিনি বিবিসির ধর্ম বিষয়ক সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন।

আলোচনায় ডায়ানার চিঠি:
বছরের পর বছর ধরে যেসব অভিযোগ ও ভুয়া নথি নিয়ে বিস্তর আলোচনা, ডায়ানা বেঁচে থাকতেই সেই বিষয়ে নিজের অবস্থান পরিষ্কার করেছিলেন। ১৯৯৫ সালের ডিসেম্বরে সাংবাদিক বশিরকে একটি চিঠি লিখেছিলেন ডায়ানা। ওই চিঠিতে তিনি লিখেছিলেন, আগে থেকে জানতেন না এমন কোনো নথি কিংবা তথ্য তিনি বশিরের কাছ থেকে পাননি এবং সাক্ষাৎকার দেওয়ার ক্ষেত্রে তা কোনো ভূমিকা রাখেনি।

তবে ডায়ানার ওই চিঠির কোনো খোঁজ এত দিন পাওয়া যায়নি। লর্ড ডাইসন জানিয়েছেন, গত বছরের নভেম্বরে সাংবাদিক বশির তাঁর বাড়িতে ডায়ানার হাতে লেখা চিঠিটি খুঁজে পান। পরে তা বিবিসির কর্মকর্তাদের দেন তিনি। যা পরবর্তীতে তদন্তের কাজে হস্তান্তর করা হয়।