পুরান ঢাকার সার্বজনীন আনন্দ উৎসব

প্রকাশ : 2022-01-14 15:45:08১ |  অনলাইন সংস্করণ

  নিউজ ডেস্ক   

পুরান ঢাকার সার্বজনীন আনন্দ উৎসব

শাশ্বত স্বপন
----------------------

 
 পৌষ সংক্রান্তি পুরনো ঢাকার ঐতিহ্যবাহী একটি উৎসবের দিন। প্রতি বছর পৌষ সংক্রান্তিতে পুরান ঢাকার বাড়ির ছাদে ছাদে বসে বিশাল এক উৎসব। হরেক রকম ঘুড়ি ছেয়ে সারা আকাশ জুড়ে উড়তে থাকে। আর সন্ধ্যা থেকে রাত পর্যন্ত ফানুশ, আতশবাজির ঝলকে পুরো আকাশ মেলা বা বিয়ে বাড়ির রূপে জেগে উঠে।
 
এ উৎসবের আরেক নাম সাকরাইন উৎসব। এটা মূলত পৌষসংক্রান্তি, ঘুড়ি উৎসব নামেও পরিচিত, বাংলাদেশে শীত মৌসুমের বাৎসরিক উৎযাপন, ঘুড়ি উড়িয়ে পালন করা হয়। সংস্কৃত শব্দ 'সংক্রান্তি' ঢাকাইয়া অপভ্রংশে সাকরাইন রূপ নিয়েছে। পৌষ ও মাঘ মাসের সন্ধিক্ষণে, পৌষ মাসের শেষদিন সারা ভারতবর্ষে সংক্রান্তি হিসাবে উৎযাপিত হয়। তবে পুরান ঢাকায় পৌষসংক্রান্তি বা সাকরাইন সার্বজনীন ঢাকাইয়া উৎসবের রূপ নিয়েছে। বর্তমানে দিনভর ঘুড়ি উড়ানোর পাশাপাশি সন্ধ্যায় বর্ণিল আতশবাজি ও রঙ বেরং ফানুশে ছেয়ে যায় বুড়িগঙ্গা তীরবর্তী শহরের আকাশ। এক কথায় বলা যায় সাকরাইন হচ্ছে এক ধরণের ঘুড়ি উৎসব।
 
 ঘুড়ি। পুরান ঢাকায় কবে, কখন, কোথায় প্রথম ঘুড়ি উৎসব শুরু হয়েছিল--তা ইতিহাস থেকে ভালোভাবে জানা যায় না। ঐতিহাসিকদের মতে, ১৭৪০ সালের দিকে নবাব নাজিম নওয়াজেস মোহাম্মদ খাঁন এর সময় থেকে ঢাকায় ‘ঘুড়ি উড়ানো’ উৎসব হিসাবে প্রচলিত হয় এবং নবাব পরিবাররা এ উৎসবের উৎসাহ দাতা ছিলেন। সেই সময় ঘুড়ি উড়ানো আনন্দ অভিজাত মহলে সীমাবদ্ধ ছিল--যা এখন সর্ব সাধারনের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে। 
 
বাংলা ক্যালেন্ডারের নবম মাস পৌষ মাসের শেষ দিনে আয়োজিত হয় যা গ্রেগরীয় ক্যালেন্ডারের হিসেবে জানুয়ারী মাসের ১৪ অথবা ১৫ তারিখে পড়ে। সাকরাইন পুরান ঢাকার মাটিতে নয়, হয় ছাদে ছাদে। ছাদে উঠলেই মনে হবে ঘুড়ি, ফানুস, নাচ, গানের যেন, প্রতিযোগিতা চলছে। 
  
এ দিন পুরনো ঢাকার দয়াগঞ্জ, মুরগীটোলা, কাগজিটোলা, গেন্ডারিয়া, বাইনা নগর, বাংলাবাজার, লক্ষ্মীবাজার, সিংটোলা, কাগজীটোলা, কলুটোলা, সূত্রাপুর, ধূপখোলা, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা, সদরঘাট, কোটকাচারী এলাকার মানুষ সারাদিন ব্যাপি ঘুড়ি উড়ায়, নানা রকমের খাবার এর আয়োজন করে। সন্ধ্যায় আগুন নিয়ে খেলা আর আতশবাজি তো আছেই । আতশবাজির লাল নীল আলোয় আলোকিত পুরান ঢাকাকে দেখতে চাইলে যেতে হবে কোনও বাড়ির ছাদে । বরাবরের মত এবারের অনুষ্ঠানও দুইদিনে ভাগ হয়েছে, সরকারীভাবে লক্ষ্মীবাজার, সিংটোলা, কাগজীটোলা, সূত্রাপুর, গেন্ডারিয়ায় ১৪ তারিখ হবে পৌষ সংক্রান্তি উৎসব। অন্যদিকে বাংলা পঞ্চিকা অনুসারে শাঁখারিবাজার ও তার আশেপাশের এলাকায় এবার পৌষ সংক্রান্তি হবে ১৫ জানুয়ারি।
  
পুরান ঢাকার ঘুড়ি উৎসবের আনন্দ বরাবরের মত এ বছরও জাঁকজমকভাবে উদযাপিত হয়েছে। প্রজাপতি, পঙ্খিরাজ, চুঁড়িদার, গাহেলদার, কাউঠাদার, চোখদার, চাঁনদার, ঘর গুড্ডি, বাক্স গুড্ডি, কয়রা ইত্যাদি নানারকমের ঘুড়ি উড়ানো; পাকার্ড, ফেস্টুন প্রদর্শনী এবং সাজানো ঘোড়ার গাড়ীতে অলি-গলি ঘুড়ে বেড়ানোর মধ্য দিয়ে পুরান ঢাকার মানুষের পৌষ সংক্রান্তি উৎসব উদযাপিত হয়েছে। মোড়ে-মোড়ে, বাড়ীর ছাদে-ছাদে, ক্লাব, সংঘ অথবা বন্ধুদের দল মিলে গান বাজিয়ে নেচে-গেয়ে সারাদিন সবাইকে মাতিয়ে রেখেছে। সকাল থেকে শুরু হওয়া হিন্দি আর  ইংলিশ গানের আওয়াজ রাত ২টা/৩টা পর্যন্ত চলে। বাংলাগান খুব একটা শুনা যায় না। তাই অনেকেই বলে থাকেন, পুরান ঢাকার মানুষেরা পৌষ-পার্বণের উৎসবকে দিন দিন বিজাতীয় উৎসবে পরিণত করছেন।
 
ইদানিং প্রায় প্রতিটি ছাদে ডিসকো পার্টি দেখা যায়। কড়া আলোক সজ্জায় ঝিকমিক করে পুরো আকাশ। ছেলেমেয়ে সবাই ওয়েস্টার্ন, হিন্দি স্টাইলে নাচানাচি করে। কোন কোন ছাদে আগুনের ফুলকি নিয়ে কিছু কিশোর তরুনেরদের মাঝে ভয়ংকর কলা কৌশল চোখে পড়ে।
 
তবে এই কয়েকদিনের কান ফাটানো চিৎকার চেঁচামেচিতে কেউ কোন বিরক্তি প্রকাশ করেছে বলে আজ পর্যন্ত শুনি নাই। পূজা-পার্বন আর ডোল-কাসার কান ফাটানো আওয়াজ তো সারা বছরই পুরান ঢাকায় লেগেই আছে, তারপর হিন্দু বিয়েতে পূজার মতই সময়-অসময় ডোল-কাসার শব্দ; আবার রমজান মাসে সেহেরীর সময় মসজিদের মাইকে বা মুসুল্লিদের ঘুম থেকে উঠার আহ্বান অথবা হাজার-হাজার গরু কোরবানীর সময়টাতেও সবাই অনেক ধৈর্য্যশীল থাকে, যেন সবই নিজেদের কাজ। শত শত বছর ধরে পুরান ঢাকার মানুষেরা এভাবেই ধৈর্য্যের অগ্নি পরীক্ষায় কালোত্তীর্ণ।
 
পৌষের শেষ দিন, কেউ বা মাঘের প্রথম দিন সনাতন হিন্দুরা বাসার কাছে খোলা জায়গায় পৌষ সংক্রান্তির পূজা করে গুচ্ছ কাঠের গুড়িতে আগুন জ্বালিয়ে। নানা রকমের শাড়ি, জড়িদার কাপড়-চোপড় পড়ে ছোট বড় সব বয়সের নারীরা আগুনের চারিদিকে পূজা সামগ্রী সাজিয়ে বসে ‘বুড়া-বুড়ির পূজা’ উদযাপন করে; পৌষ মাসকে বিদায় জানিয়ে মাঘ মাসকে গ্রহণ করে।
 
পুরাণ ঢাকায় সাকরাইন পহেলা মাঘে পালন হয়। এ বছর এটা ১৪ জানুয়ারি হবে। তবে তাঁতীবাজার ও শাঁখারিবাজারের আদি হিন্দু পরিবারগুলি ১৫ জানুয়ারিকে পহেলা মাঘ মেনে এ উৎসব পালন করে। এদিন পুরাণ ঢাকার আকাশ ঘুড়িতে ঢেকে যায়। সন্ধ্যায় মুখে কেরোসিন নিয়ে আগুনে ফু দিয়ে আকাশে অগ্নিকুণ্ড তৈরি, ফানুস উড়ানো অথবা আতশবাজিতে মুখর থাকে আকাশ। সাকরাইনের সপ্তাহ খানিক আগে থেকে চলে প্রস্তুতি। সূতোয় কাঁচ, রঙ দিয়ে ‘মাঞ্জা’ দেয়া হয়। শাঁখারিবাজারের দোকানগুলিতে পাওয়া যায় বিভিন্ন আকার, আকৃতির ঘুড়ি। অনেকে ব্যক্তিগতভাবে বানিয়ে নেন ঢাউস ‘ল্যাঞ্জার’ ঘুড়ি। ঘুড়ির লেজকে পুরাণ ঢাকায় বলে ল্যাঞ্জা। ছাদে ছাদে বন্ধু বান্ধবের দল টাকা তুলে এসব আয়োজন করে। লাখ লাখ টাকার বাহারি আতশবাজি ফোটানো হয় সাকরাইনকে কেন্দ্র করে। সাকরাইনের আগ থেকেই অনেক দেশি ও বিদেশি পর্যটক ভিড় জমায় এখানে। নতুন ঢাকাসহ দেশের নানান এলাকা থেকে মানুষ আসে পুরাণ ঢাকায়।
 
পৌষ সংক্রান্তির আগমন উপলক্ষে পুরান ঢাকার ছাদে ছাদে গত কয়েকদিন ধরে বর্নাঢ্য ঘুড়ি উৎসব চলছে, তবে ১৪ ও ১৫ তারিখে সবচেয়ে বেশি ঘুড়ি আকাশে দেখা গেছে।ছোট বড় সবাই নানা রঙের সূতা মেজে, হরেক রকমের ঘুড়ি উড়িয়ে, বিচিত্র রকমের পিঠার আয়োজনে নাচ-গান-বাজনার মধ্য দিয়ে সারা দিনব্যাপী ঘুড়ি উৎসবের আযোজন করে। রাতের বেলা পটকা ফাটিয়ে, আকাশে নানা রকম আতশবাজি জ্বালিয়ে কিশোর-যুবকরা আনন্দ করেছে। আবার কেউ কেউ মুখের ভিতর কেরোসিন তেল নিয়ে সামনে মশাল রেখে মুখের তেল মশালের উপর ছুড়ে মারে--হঠাৎ করে আগুন জ্বলে ওঠে ঘন কুয়াশার অন্ধকারে। কেউ কেউ রাতের আঁধারে ঘুড়ির সূতার সাথে আলোকিত ফানুশ বেঁধে আকাশে উঁড়িয়ে দেয়; দূর থেকে দেখলে মনে হয়, আকাশে যেন ধুমকেতুর গুচ্ছ জ্বলছে। পৌষকে বিদায় দেবার এ যেন অন্য রকম পৌষ সংক্রান্তি উৎসব।