পীড়াদায়ক প্রশান্তি

প্রকাশ : 2024-03-14 16:12:12১ |  অনলাইন সংস্করণ

  নিউজ ডেস্ক   

পীড়াদায়ক প্রশান্তি

দিনকয়েক আগে কৈশোর কালের বিখ্যাত একজন বন্ধু আমার মুঠোফোনে আমাকে জানাইলেন তাহারা কয়েকজন বন্ধুবর্গ মিলিয়া এ বৎসর ইদুর ও উইপোকার ষড়যন্ত্রের শিকার কতিপয় বানভাসী মানুষকে ত্রাণ দিবেন বলিয়া সিদ্ধান্ত লইয়াছেন। বেকারত্বের কারণে আশানুরূপ আর্থিক সহযোগিতা করিতে পারিলাম না, তবে তাহাদের সহিত যাইবার বায়না ধরিলাম। জানিতে পারিলাম তাহারা দিন দুয়েক পর দিবাগত রাত ১টার দিকে ত্রাণ লইয়া সিরাজগঞ্জ যাইবেন। 

আমি আমার এক বন্ধুকে সাথে লইয়া তাহাদের ডেরায় যখন প্রবেশ করিলাম তখন রাত ১১ টা, সাথে আরো কয়জন অপরিচিত মুখ দেখিলাম । দেখিলাম তাহারা কয়েকজন মিলিয়া দ্রব্যসামগ্রী প্যাকিং করিতেছেন। ক্ষনকাল কাজ করিয়াই বুঝিতে পারিলাম ইহারা শাদা মনের মানুষ। সবার ব্যস্ততার কারণে যে প্যাকিং কার্যক্রম দ্বিপ্রহর শুরু হইবার কথা ছিল তাহা নাকি মাত্রই শুরু হইয়াছে। যাইহোক, ৪ কেজি চাল, ২ কেজি আলু, ৫০০ গ্রাম মসুর ডাল, ৫০০ গ্রাম লবণ, ৫০০ গ্রাম চিড়া, ৫০০ গ্রাম গুড় ও স্যালাইন সমেত প্রতিটি এরকম ২৫০ টি প্যাকেট সম্পন্ন করিতে করিতে সূর্য পূর্ব গগনে উকি দিয়া ফেলিল। বিপত্তি বাধিল যখন ভাড়াকৃত গাড়ি আসিল, ইহাতে এত পরিমাণ জায়গা যে, যদি ত্রাণসামগ্রী উঠানো হয় আমরা বসিতে পারিব না, আর আমরা বসিলে ত্রাণসামগ্রী লওয়া যাইবে না। সকলে জোট বাধিয়া যখন চালকের গুষ্ঠি উদ্ধারে ব্যস্ত, আমি দুইজন বন্ধু সহিত তৈল চালিত দ্বি-চক্রযানে করিয়া ছুটিলাম গাড়ির সন্ধানে। নতুন গাড়িতে মালামাল তুলিয়া সবাই উঠিলাম, পিকআপ চালক বাশ আর ত্রিপলের সহিত তখন ছাউনি তৈরী করিতেছে। আমরা কয়েকজন 29 খেলিতেছিলাম। তৎক্ষনাৎ একদল পুলিশ আসিয়া আমাদের বাক্যবানে আক্রান্ত করিল। আমাদেরকে পিকআপ হইতে নামাইয়া রিমান্ডে লইলেন। সবাই ছাত্র জানিয়া ওসি সাহেব আমাদের মৌখিক পরীক্ষা আরম্ভ করিলেন। আমাকে সহ আরো কয়েকজনকে ইংরেজি ট্রান্সলেশন জিজ্ঞাসা করিলেন, সঠিক হইলেও তাহার মনঃপুত না হওয়ায় তিনি আরো রাগান্বিত হইলেন। শেষে আমাকে জিজ্ঞাস করিলেন Intermediate বানান কর, যদি ইহা না বলিতে পারো তবে তোমায় শ্বশুরালয়ে লইয়া যাইব। তাহার আশা ভঙ্গ হইল। আমাদের মহতি উদ্যোগের কথা জানিয়া তিনি আমাদিগকে শুভকামনা জানাইলেন। 

সকাল ১০ ঘটিকায় আমরা যাত্রা শুরু করিলাম। আমাদের পরিকল্পনা হইল ২/৩ ঘটিকার দিকে সিরাজগঞ্জ যাইয়া ৬ ঘটিকার মধ্যে বিতরণকার্য শেষ করিয়া রাতের ট্রেনে বাড়ি ফিরিব। পথিমধ্যে ক্ষুধা নিবারণের জন্য সিঙাড়া কিনিলাম। আমরা সর্বমোট ১২ জন, ২৪ টি গরম সিঙাড়া কিনিয়া আবার যাত্রা শুরু করিলাম। জনপ্রতি ২টি করিয়া সিঙাড়া, একটুপর আবিষ্কৃত হইল দোকানি প্রায় ৬ খানা সিঙাড়া কম দিয়াছে। আমরা আবেগাপ্লুত হইয়া দোকানিকে ৬ খানা সিঙাড়া ত্রাণ দিয়াছি ভাবিয়া নিদ্রাযাপনে চলিয়া গেলাম। আমরা যখন সিরাজগঞ্জ এনায়েতপুর পৌছিলাম তখন সূর্য মুখ লুকাইয়া ফেলিয়াছে। আমাদের ত্রাণ দিবার স্থান তখনো অনেক দূরে। থানার ওসি বলিলেন, "আপনারা এই সন্ধ্যায় না যাইয়া আগামিকাল ভোর বেলায় ত্রাণ দিবার উদ্দেশ্যে যাত্রা করিবেন। এই সন্ধ্যাবেলায় যাত্রা করিলে সমূহ বিপদের আশঙ্কা রহিয়াছে। আমরা যেন আগামিকাল প্রথম প্রহরে ত্রাণ বিতরণ করি, তাহা হইলে তিনিও থাকিবার চেষ্টা করিবেন তাহার সহকর্মীদের লইয়া। কিন্তু, আমাদের তো রাতের ট্রেনে বাড়ি ফিরিতে হইবে। দীর্ঘ ২ ঘন্টার আলোচনায় সিদ্ধান্ত হইল যাদের বাড়ি না ফিরিলেই না, তারা আজ চলিয়া যাইবে আর বাকিরা আগামিকাল ত্রাণ বিতরণ শেষ করিয়া বাড়ি ফিরিবে। ৪ বন্ধু বাড়ির পথ ধরিল। বেকার হইবার সুবাদে আমি থাকিয়া গেলাম, সাথে আরো সাত বন্ধু। 

রাত্রিযাপন করিয়া মালামাল প্যাকিং করিয়া দিনভর ধূলাবালি সহিত ভ্রমণ করিয়াও কার্যসম্পাদন না করিতে পারিবার যন্ত্রনায় আমরা শোকস্তদ্ধ। হয়তো সৃষ্টিকর্তা ইহা বুঝিতে পারিয়াই আমাদের ৮ বন্ধুকে গোসল সারিয়া রাতের আহার শেষ করিয়া বিছানায় গা এলাইয়া দিয়া নিদ্রায় যাইবার মতো স্বর্গসুখ দিয়াছেন। আর এরই ফাকে যমুনাতীরে মাচাতে শুইয়া, কায়ায় যমুনার হিমশীতল বাতাস লাগাইয়া বিশালাকার গগনের তারাসমূহের খেলা দেখিবার মধ্যে যে আনন্দ তাহা বোঝাইবার সাধ্য আমি অধমের মাথায় খেলে না। পরদিন সকালে উঠিয়া প্রাতরাশ সারিয়া ওসি সাহেবের অপেক্ষা করিতে লাগিলাম। তিনি আসিতে না পারার দুঃখ প্রকাশ করিয়া তাহার এস আই ও কয়েকজন অধীনস্তকে পাঠাইলেন। আমরা যমুনার ঘাটে রহিলাম। তাহারা ২ ঘন্টা পর হেলিয়া দুলিয়া আসিলেন আর তাহার সাথে সাথেই আসিল ভারি বর্ষণ। আমি ও আরো দুইজন বন্ধু একটি টং দোকানে আশ্রয় লইলাম, বাকিরা পুলিশ দেরকে সঙ্গ দিতে লাগিল। আকাশ ভাঙিয়া বর্ষণ শুরু হইল। 

আমরা কলা খাইতছিলাম, হঠাৎ এমনি জোরে বাতাস আসিল যে, টং দোকানের চাল উড়াইয়া বেশ দূরে গিয়া পড়িল। ভারি বর্ষণ শেষ হইলে আমরা ৮ বন্ধু আর ৪জন পুলিশসহ ট্রলারে করিয়া যাত্রা শুরু করিলাম। উদ্দেশ্যে যমুনার বুকের প্রত্যন্ত নওহাটা চরাঞ্চল যমুনার কালো বুক চিরে। দ্বিপ্রহর পৌছাইয়া চরাঞ্চলের মানুষের জীবন যাপনে আশাহত হইলাম। ইহারা শহরতলীর অনেক মানুষ অপেক্ষা ধনী। কাহারো হাতে দামি ব্র্যান্ডের মুঠোফোনন দেখিয়া পুলকিত হইলাম। তবে, তাহার মধ্যেও হতদরিদ্র রহিয়াছে। আমাদের ত্রাণ বিতরণ শুরু হইল, সবাই ঝাপাইয়া পড়িল প্রতীক্ষিত ত্রাণ বিতরণে। সূর্যের তাপে আমাদের সকলেই প্রায় দূর্বল হইয়া পড়িল, তাও কাজ থামিল না, এই শাদা মনের মানুষদিগের কর্মস্পৃহা দেখিয়া নয়ন আমার ভিজিয়া উঠিল। কেহ বুঝিবার আগেই সরিয়া গেলাম। এস আই সাহেব আরো আগেই সরিয়া গিয়াছেন। উনার সহিত আলাপ শুরু করিলাম। উনার মুখে উনাদের কার্যক্রম লইয়া যাহা শুনিলাম তাহা এই গনতান্ত্রিক সময়ে প্রকাশ করিবার মতো নহে। আর ইহাও বুঝিতে পারিলাম তাহার মতো কতিপয় ভালো পুলিশদের লাগিয়াই এখনো আমরা ভালো রহিয়াছি। আরো ২ ঘন্টা রোদে পুড়িবার পর আমাদের কাজ শেষ হইল। আমরা ফিরতি পথ ধরিলাম। আসার কালে যমুনার বুকে জনাকয়েক মাঝি ও চরের কিছু পরিবারকে রয়ে যাওয়া ত্রাণ সমূহ বিলিয়ে দিলাম। তাহাদের মুখের হাসি আমাকে নিদ্রারত অবস্থায়ও মুচকি হাসতে সাহায্য করিতেছে। ঘাটে ফিরিয়া আসিয়া গোলাম হোটেলে ধোয়াপূর্ণ ভাত আর যমুনার সুস্বাদু গুলশা মাছ দিয়া দুপুরের আহার সম্পন্ন করিলাম। গুলশা মাছ, এ যেন মর্ত্যের অমৃত। পুলিশদিগকে বিদায় দিয়া আমি ও সেই শাদা মনের মানুষগুলি সি এন জি করিয়া ১২ ক্রোশ পথ পাড়ি দিয়া সিরাজগঞ্জ রেলওয়ে স্টেশনে আসিলাম। যথারীতি বিলম্বে আসিল। ট্রেনে চাপিয়া শহরে আসিয়া বাকি বন্ধুদের হইতে বিদায় লইয়াবাড়িতে আসিলাম। রাতের আহার শেষ করিয়াই আপনাদিগের সময় নষ্ট করার নিমিত্তে এই দুঃসাহস করিলাম। 

লেখক- মহসিন হোসাইন কিশোর...সা

সান