পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত সুইডিশ বিচারপতি সমাহিত হতে চান বাংলাদেশে
প্রকাশ : 2022-12-11 11:16:40১ | অনলাইন সংস্করণ
নিউজ ডেস্ক
পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত সুইডিশ বিচারপতি সৈয়দ আসিফ শাহকার মৃত্যুর পর বাংলাদেশে সমাহিত হওয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে চিঠি লিখেছেন। মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রী সম্মাননাপ্রাপ্ত এই সুইডিশ বিচারপতি ও কবি টেলিফোন আলাপে বাসসকে তার এই অন্তিম ইচ্ছের কথা জানান।
বিচারপতি সৈয়দ আসিফ বলেন, আমার বয়স ৭২ বছর। আমি জানি না, আর কতদিন বাঁচব। কিন্তু বাংলাদেশের একজন শুভাকাঙ্ক্ষী হিসেবে আমি বাংলাদেশের মাটিতেই সমাধিস্থ হতে চাই। বাংলাদেশের নাগরিক না হলে যেহেতু সেখানে সমাধিস্থ হতে পারব না, তাই, বাংলাদেশের নাগরিকত্ব চেয়ে আমি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে একটি চিঠি লিখেছি।
সৈয়দ আসিফ শাহকার পাকিস্তানের পাঞ্জাবের হরপ্পায় জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৭১ সালে তিনি ২২ বছরের তরুণ। পাঞ্জাব স্টুডেন্ট ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। ২৫ মার্চের কালরাত্রে পূর্ব পাকিস্তানের ওপর পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামের নির্মম ও নৃশংস গণহত্যার প্রতিবাদে পশ্চিম পাকিস্তানের নাগরিকদের একটি অংশ প্রতিবাদী হয়ে ওঠে। তাদের সাথে প্রতিবাদ, সমাবেশ, কবিতা লেখা ও লিফলেট বিতরণ করেন এই তরুণ। আর তার পরিণামে তিনি নিজ পরিবার, সমাজ ও দেশের মানুষের কাছে ঘৃণার পাত্র হয়ে ওঠেন। তাকে ‘দেশদ্রোহী’ হিসেবে কারাদণ্ড দেওয়া হয়। মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস তিনি পাকিস্তানের কারাগারে নানারকম মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন সহ্য করেন। কিন্তু তিনি বাংলাদেশের বিপক্ষে যাননি। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের বিজয় অর্জনের পর সৈয়দ আসিফ বন্দিদশা থেকে মুক্তি পান।
সৈয়দ আসিফ বলেন, বাংলাদেশের বিজয় না হলে আমি কারাগার থেকে মুক্ত হতে পারতাম না। আমাকে পাকিস্তানের কারাগারেই মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হতো অথবা কারাগারেই জীবন পার হয়ে যেত।
জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর তিনি কিছুদিন লাহোরে পাকিস্তান টেলিভিশনে প্রযোজক হিসেবে কাজ করেন। কিন্তু নিজ দেশে ‘কুলাঙ্গার’ হিসেবে স্থায়ী পরিচিতি নিয়ে তিনি বেশিদিন পাকিস্তানে থাকতে পারেননি। ১৯৭৭ সালে তিনি সুইডেনে রাজনৈতিক আশ্রয়ে যান। নতুন এক জীবনযুদ্ধ শুরু করেন। পরবর্তীতে সেখানেই তিনি হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পান।
স্বাধীনতার ৪১ বছর পর ২০১২ সালে বাংলাদেশ সরকারের আমন্ত্রণে বিচারপতি আসিফ মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রী সম্মাননা গ্রহণের জন্য বাংলাদেশে আসেন। তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১২ সালের ১৫ ডিসেম্বর তার হাতে এই সম্মাননা তুলে দেন। সৈয়দ আসিফ নিজেকে পাকিস্তানের নাগরিক নয়, বরং বাংলাদেশের নাগরিক ভাবতে ভালোবাসেন। তাই তিনি বাংলাদেশের নাগরিকত্বের জন্য আবেদন জানিয়েছেন। যাতে তার মৃত্যুর পর তাকে বাংলাদেশের মাটিতে সমাধিস্থ করা হয়।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে ইংরেজিতে লেখা ৭৬৭ শব্দের দীর্ঘ চিঠিতে তিনি বাংলাদেশ, বাংলাদেশের মানুষের প্রতি তার ভালোবাসার পাশাপাশি এ দেশের মাটিতে সমাহিত হওয়ার আকুল বাসনা ব্যক্ত করেছেন।
তিনি লিখেছেন, বাংলাদেশের প্রতি আমার ভালোবাসা হয়তো আমি সারাজীবনেও ভাষায় প্রকাশ করে শেষ করতে পারব না। আমি যখন বাংলাদেশে গিয়েছিলাম তখন আমাকে যে ভালোবাসা, সম্মান ও শুভেচ্ছা জানানো হয়েছে, তাতে আমি প্রচণ্ড বিহ্বল এবং আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছিলাম। যখন বাংলাদেশ থেকে সুইডেনে রওনা হব তখন অনুভব করছিলাম যে, আমার চলে যাওয়া হবে এক প্রাণহীন প্রস্থান এবং আমার আত্মা পেছনে রয়ে যাবে।
সুইডেনের স্টকহোমে বসবাসরত অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি সৈয়দ আসিফ শাহকার বাংলাদেশের জন্য আজও কাজ করে যাচ্ছেন। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বাংলাদেশের ওপর যে নৃশংস গণহত্যা পরিচালনা করেছে তার বিচারের দাবিতেও তিনি সোচ্চার। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পৃথিবীর আর কোনো দেশে এত বড় গণহত্যা সংঘটিত হয়নি। তা সত্ত্বেও বাংলাদেশের গণহত্যাকে জাতিসংঘ আজও স্বীকৃতি দেয়নি। গত ৩ অক্টোবর জেনেভায় জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিলের সদর দফতরে জাতিসংঘের স্বীকৃতি আদায়ের দাবিতে এক আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়। আলোচনা সভায় সৈয়দ আসিফ শাহকার আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন এবং বাংলাদেশের গণহত্যাকে স্বীকৃতি দেয়ার জন্য এবং হত্যাকারীদের বিচারের জন্য জাতিসংঘের প্রতি জোরালো আবেদন জানান।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে লেখা চিঠিতে সৈয়দ আসিফ বলেন, বাংলাদেশের একজন মুক্তিযোদ্ধা যখন বাংলাদেশের নাগরিক হতে পারেন, এখানে থাকতে পারেন, একটি বাড়ির মালিক হতে পারেন, তখন মুক্তিযুদ্ধে সমর্থনকারী বিদেশি হয়েও কেন মৃত্যুবরণকারী বাংলাদেশের অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধার মতো আমাকে এখানে দাফন করা যাবে না। আমি কেন বাংলাদেশের নাগরিক হতে পারব না? চিঠিতে তিনি আমৃত্যু বাংলাদেশের জন্য কাজ করার ইচ্ছাও প্রকাশ করেন।