নির্বাচন কমিশন সম্পর্কে যে আস্থার সংকট রয়েছে, তা দূর করার পরামর্শ

প্রকাশ : 2022-04-18 18:12:25১ |  অনলাইন সংস্করণ

  নিউজ ডেস্ক   

নির্বাচন কমিশন সম্পর্কে যে আস্থার সংকট রয়েছে, তা দূর করার পরামর্শ

সাধারণ মানুষ, গণমাধ্যম, সর্বোপরি রাজনৈতিক দলগুলোর ভেতর নির্বাচন কমিশন (ইসি) সম্পর্কে যে আস্থার সংকট রয়েছে, তা দূর করার জন্য পরামর্শ দিয়েছেন গণমাধ্যম ব্যক্তিত্বরা। একইসঙ্গে তারা সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে নিজেদের ক্ষমতা প্রয়োগ করার কথাও বলেন।
 
সোমবার (১৮ এপ্রিল) নির্বাচন ভবনের সভাকক্ষে আয়োজিত এক সংলাপে এমন পরামর্শ দেন ইলেকট্রনিক মিডিয়ার জ্যেষ্ঠ সাংবাদিকরা। প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়ালের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সংলাপে চার নির্বাচন কমিশনার, ইসি সচিবসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।  

একাত্তর টিভির প্রধান সম্পাদক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোজাম্মেল বাবু বলেন, ৫০ বছরে নির্বাচন কমিশন বিতর্কিত হয়েছে। কখনো কখনো দলগুলো ইচ্ছাকৃতভাবে ইসিকে বিতর্কিত করেছে। এটা একটা রাজনৈতিক উদ্দেশ্য। আপনাদের এটার ঊর্ধ্বে থাকতে হবে। সবচেয়ে ভালো ইসি যাকে আমরা বলি, সেটা হচ্ছে ড. শামসুল হুদা কমিশন। সেই কমিশন বিএনপিকে ভাঙার জন্য মেজর হাফিজের নেতৃতাধীন অংশকে ধানের শীষ প্রতীক দিতে চেয়েছিল। এটিই বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে জঘন্যতম নির্বাচন কমিশন ছিল। কাজেই পারসেপশন একটা অদ্ভূত খেলা। শামসুল হুদা ও সাখাওয়াত হোসেনের মতো এতো রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা আর কারো ছিল না। কাউকে নির্বাচনে আনা বা না আনা, দল ভাঙার কাজ তো আপানাদের না। চোখ-কান বন্ধ করে সোজা হাঁটেন। বড় দলগুলো না এলে একতরফা হয়ে যায়। এর বাইরে কাউকে আনা বা না আনা আপনাদের কাজ না।  

তিনি আরও বলেন, ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ইজ দ্য সল্যুশন, ইভিএম ইজ দ্য প্রবলেম। দেখা যায় নাতো, এটা একটা সমস্যা। পেপার টেইল ইজ দ্য সল্যুশন। আরেকটা ব্যবস্থা করা যায় যে, টিপ দিলে স্লিপ বের হয়ে আসবে। এতে চ্যালেঞ্জ এলে পুনরায় কাউন্ট করা যাবে।  

এছাড়া মোজাম্মেল বাবু দলগুলোকেও জবাবদিহিতায় আনার কথা বলেন। দলের প্রতিটি স্তরে ৩৩ শতাংশ নারী সদস্য পদ পূরণ, সব ধর্মের প্রতিনিধিত্ব রাখা ইত্যাদি বিষয় তারা মানছে না কেন? অতএব গোড়ায় হাত দেন।  

জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক মঞ্জুরুল আহসান বুলবুল বলেন, আপনারা জানেন আপনাদের কাজটা কী? ডানে-বায়ে কিছুই নেই ভালো নির্বাচন করা ছাড়া। সহিংসতা না ঘটানো নিশ্চিত করা, সবাই যেন নির্বাচনের ফলাফল মেনে নেয় সেটা নিশ্চিত করা। নির্বাচন কমিশন হতভাগা প্রতিষ্ঠান। যারাই হেরেছে, তারাই নির্বাচন কমিশনকে দোষ দিয়েছে। কাজেই আপনারা হতাভাগা প্রতিষ্ঠানে এসেছেন। সেটা একটা সাহসের জায়গা।

তিনি আরও বলেন, আস্থার সংকট দূর করা দরকার। ইভিএম নিয়ে আস্থার সংকট দূর করা। এনআইডি যদি সংশোধন না করেন তাহলে কিন্তু অসংখ্য মানুষে খুনের দায়ে দায়ী হবেন। কেননা অনেকেই জীবিত থেকেও মৃত হয়ে আছে আপনাদের সার্ভারে।

গ্লোবাল টিভির এডিটর ইশতিয়াক রেজা বলেন, নিজেদের ভেতর সংহতি একজন নির্বাচন কমিশনার সব সময় নির্বাচন কমিশনের বাইরে এসে কথা বলেছেন। এটা সব সময় নির্বাচন কমিশন সম্পর্কে মানুষের মনে ভালো বার্তা দেয় না। সুতরাং নিজেদের ভেতরে সংহতি ও ঐক্যটা এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ জায়গা। বেশ কিছু নির্বাচন অত্যন্ত সহিংসতার মধ্যে হয়েছে। ক্ষমতার ব্যবহার দৃঢ়তার অভাব দেখেছি। সংসদের উপ-নির্বাচনের জটিলতা হয়েছে। নির্বাচনী অনিয়ম হওয়ার পর গেজেট প্রকাশ না করার মনোভাবও দেখতে পাই না।  

তিনি আরও বলেন, সরকারও চায় ভালোভাবে নির্বাচন হোক, সবগুলো দল অংশ নেক। সমস্ত চোখ কমিশনের দিকে থাকবে। যেটুকু করার ক্ষমতা আছে, আইনে যে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, সেই জায়গা থেকে মানুষের ভাবনার প্রতিফলিত হয়, সেটাই হলো দেখবার জায়গা।  

নিউজ২৪-এর এক্সিকিউটিভ এডিটর রাহুল রাহা বলেন, নির্বাচনকালীন মিথ্যা প্রচার, অপপ্রচার রোধে নজরদাবি করতে হবে। ভোট নিয়ে আস্থা ফেরাতে বড় দুই দলের মহাসচিব পর্যায়ে সংলাপের উদ্যোগ নেওয়ার আহ্বানও জানান তিনি।

বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান সম্পাদক আবুল কালাম আজাদ বলেন, কথায় কথায় ইসিকে পদত্যাগের কথা বলা হয়। পদত্যাগের পরামর্শ শুভ চিন্তা নয়। পদত্যাগে বাহাদুরির কিছু নেই। ভোটে আসা না আসা দলগুলোর নিজের সিদ্ধান্তের বিষয়। জামাই আদর করে কাউকে ডেকে আনতে হবে না। যে দলের নীতি নির্ধারকরা ঠিক করে রেখেছেন ভোটে আসবেন না, তাদের আপনারা কী করে নির্বাচনে আনবেন? 

এটিএন বাংলার প্রধান নির্বাহী সম্পাদক জ ই মামুন বলেন, আমরা চাই এমন একটি নির্বাচন হোক, যেখানে বিএনপি ও আওয়ামী লীগ অংশগ্রহণ করবে। রাজনৈতিক দলগুলোকে নির্বাচন আনা কমিশনের এখতিয়ারের মধ্যে পড়ে কিনা আমি জানি না। সাংবাদিকদের সঙ্গে সংলাপ করার বিষয়টি আরপিও’তে নেই। আমরা জানি আপনাদের উদ্দেশ্য মহৎ ও ভালো। আপনারা চান একটি ভালো নির্বাচন হোক। আপনারা চেষ্টা করবেন বিএনপি যাতে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারে। সে রকম একটি আস্থার পরিবেশ তৈরি করতে হবে।  

তিনি আরও বলেন, নির্বাচন কমিশন যদি স্বাধীনভাবে কথা বলতে চায়, স্বাধীনভাবে কাজ করতে চায়, তাহলে তাদের পক্ষে অনেক কিছু করা সম্ভব। একটি সুষ্ঠু নির্বাচন করার জন্য গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ যথেষ্ট। নির্বাচন কমিশনের মেরুদণ্ড শক্ত থাকলে সরকারের খুব বেশি কিছু করার ক্ষমতা থাকে না। আপনারা চাইলেই সুষ্ঠু নির্বাচন করতে পারবেন। বাংলাদেশের মানুষ, বাংলাদেশের গণমাধ্যম আপনাদের সহায়তা করবে।  

নাগরিক টিভির হেড অব নিউজ দীপ আজাদ বলেন, নির্বাচন কমিশনকে যে ক্ষমতা দেওয়া আছে, চাইলে সেই ক্ষমতা বলে সুষ্ঠু নির্বাচন করতে পারে। তবে সেই ক্ষমতা তারা ব্যবহার করতে চায় কিনা এটা একটা বড় প্রশ্ন? ভোট কেন্দ্রের দায়িত্বে কে থাকবে পুলিশ নাকি প্রিজাইডিং অফিসার। গণমাধ্যমের জন্য সবচেয়ে বড় একটি বাধা হয়ে দাঁড়ায় যখন পুলিশ ভোটকেন্দ্রের দায়িত্বে থাকে। কাজেই প্রিজাইডিং কর্মকর্তার কর্তৃত্ব নিশ্চিত করার আহ্বান জানান তিনি।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম-এর প্রধান সম্পাদক তৌফিক ইমরোজ খালিদী বলেন, সবাই নির্বাচনে আসবে, সাধারণ মানুষের বিশ্বাস করতে হবে, রাজনৈতিক দলগুলোর আস্থা অর্জন করতে হবে। আরেকটি কথা নির্বাচন কমিশনার হিসেবে এটিই আপনাদের পেশাগত জীবনের শেষ অ্যাসাইনমেন্টে। এরপর হয়তো আর কোনো রাষ্ট্রীয় কাজ পাবেন না। এটি মাথায় রেখে কাজ করলে ভালো কাজ করতে পারবেন।

বাংলা ট্রিবিউনের হেড অব নিউজ মাসুদ কামাল বলেন, মূল সংকটটি কোথায় তা ভালো বোঝেন বলেই আপনারা দায়িত্বটা নিয়েছেন। না বুঝলে হয়তো আপনারা দায়িত্ব নিতেন না। আরও কিছু বোঝার জন্য এ সংলাপ করছেন। নির্বাচন কমিশনের সবচেয়ে বড় সংকট হল আস্থার সংকট। মানুষ নির্বাচন কমিশনের কথাবার্তায় বিশ্বাস করে না। গত দু’টি নির্বাচনে এ বিশ্বাস শূন্যের কোটায় নেমে এসেছে।

তিনি আরও বলেন, যদি প্রত্যেক নাগরিককে আপনি ভোট দেওয়া নিশ্চিত করতে পারেন তাহলে বুঝবো আপনি সফল। এ বিষয়টি আপনি অর্জন করতে পারবেন কিনা তাই মুখ্য বিষয়।

বেলা সোয়া ১১টা থেকে প্রায় আড়াই ঘণ্টাব্যাপী সংলাপে অন্যদের মধ্যে অংশ নেন- এনটিভির বার্তা প্রধান জহিরুল আলম, জাগোনিউজের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক কে এম জিয়াউল হক, চ্যানেল আইয়ের প্রধান বার্তা সম্পাদক জাহিদ নেওয়াজ খান, আরটিভির সিইও সৈয়দ আশিক রহমান, একুশে টিভির হেড অব নিউজ রাশেদ চৌধুরী, বাংলাভিশনের হেড অব নিউজ আব্দুল হাই সিদ্দিক, মাইটিভির হেড অব নিউজ শেখ নাজমুল হক সৈকত, সময় টিভির হেড অব নিউজ মুজতবা দানিশ, ইন্ডিপেন্ডেন্ট টিভির চিফ নিউজ এডিটর আশিস সৈকত, মাছরাঙ্গা টিভির হেড অব নিউজ রেজোয়ানুল হক রাজা, চ্যানেল টোয়েন্টিফোরের নির্বাহী পরিচালক তালাত মামুন, দেশ টিভির চিফ নিউজ এডিটর বোরহানুল হক সম্রাট, বাংলা ট্রিবিউনের বার্তা প্রধান মাসুদ কামাল, ডিবিসি নিউজের সিইও মঞ্জুরুল ইসলাম, সাংবাদিক মোস্তফা ফিরোজ, যমুনা টিভির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ফাহিম আহমেদ ও স্পাইস টিভির এডিটরিয়াল হেড তুষার আব্দুল্লাহ।  

প্রিন্ট মিডিয়ার সম্পাদক ও জ্যেষ্ঠ সাংবাদিকদের সঙ্গে গত ৬ এপ্রিল সংলাপে বসছিল নির্বাচন কমিশন (ইসি)। এতে তারা ইসিকে সব বিতর্কের ঊর্ধ্বে থেকে দলগুলোর আস্থা অর্জনের পরামর্শ দেন। এছাড়া নির্বাচনে জেলা প্রশাসকদের পরিবর্তে ইসির নিজস্ব কর্মকর্তাদের রিটার্নিং কর্মকর্তা নিয়োগ ও বিভাগভিত্তিক একাধিক দিনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের সুপারিশও করেন তারা।  

কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন বর্তমান কমিশন দায়িত্ব নিয়েই সংলাপে আয়োজন করে। এর আগে শিক্ষাবিদ ও বিশিষ্ট নাগরিকদের সঙ্গে দু’দফায় সংলাপ করেছে ইসি।  

আমন্ত্রিতরা ইসির সঙ্গে বৈঠকে বসে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনের সীমিত ব্যবহার, নির্বাচনের সময় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নিজেদের অধীন আনা, দলগুলোর আস্থা অর্জনসহ একগুচ্ছ প্রস্তাব দেন।  

নির্বাচন কমিশন এরপর নারী নেত্রীদের সঙ্গে বসতে পারে। সবশেষে বসবে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে।

সংলাপ থেকে বেরিয়ে সিইসি সাংবাদিকদের বলেন, কে নির্বাচনে অংশ নেবে, বা নেবে না, সেটা ফোর্স করা আমাদের পক্ষে সম্ভব না। তবে দায়িত্ব থাকবে আহ্বান করা, যে আপনারা আসেন। নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন। নির্বাচনে অংশ না নিলে কিন্তু গণতন্ত্র বিকশিত হবে না। গণতন্ত্র বিকিশিত হয় কিন্তু নির্বাচনের মাধ্যমে।

তিনি আরও বলেন, সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ প্রতিটি ভোটকেন্দ্রে যাতে ভোটাররা নির্বিঘ্নে ভোট দিতে পারে, তা নিশ্চিত করা। অনেক সময় কারচুপি হয়, সেটা রোধ করতে হবে। আমরা আমাদের সামর্থ্য, দক্ষতা ও বৃদ্ধি দিয়ে চেষ্টা করবো। জাতিটা সবার। আপনারাও আমাদের সহায়তা করবেন।