নব্য আলাদীন ও আধুনিক চেরাগ
প্রকাশ : 2021-09-19 12:29:33১ | অনলাইন সংস্করণ
নিউজ ডেস্ক
আরব্য উপন্যাসের আলাদীনের চেরাগের কথা শোনেন নি এমন কেউ আছেন বলে মনে হয় না। আলাদীন নামের এক দরিদ্র ধীবর (জেলে) সাগরে জাল ফেলে মাছ ধরার চষ্টা করছিল। দীর্ঘক্ষণ চেষ্টা করেও সে কোনো মাছ পাচ্ছিল না। ঘরে তার বৃদ্ধা মা না খেয়ে আছেন। অনাহারক্লিষ্ট মায়ের মুখটি মনে করে ভগ্নমনোরথ আলাদীন আরেকবার জাল ফেলল। এবারও মাছ উঠল না। তবে জালে উঠে এলো একটি পুরনো শ্যাওলাপড়া চেরাগ। আলাদীন ভাবল, এটাকে ঘঁষেমেজে বাজারে বিক্রি করে খাবার কিনে নিয়ে যাবে মায়ের জন্য। চেরাগটিতে ঘঁষা দিতেই তা থেকে কালো ধোঁয়ার কুন্ডলি বেরিয়ে এলো। আলাদীন হতচকিত হয়ে দূরে সরে গেল। একটু পরে ধোাঁয়ার কুন্ডলি রূপ নিলো বিশালকায় এক দৈত্যের। তাকে দেখে ভয় পেয়ে গেল আলাদীন। দৈত্য তখন অট্টহাসি দিয়ে বলল, ‘ভয় পাবেন না। আমি আপনার গোলাম। আমাকে হুকুম করুন।’ সে জানাল ওই চেরাগের মধ্যেই তার বসবাস। এক জাদুকর তাকে বন্দী করে সাগরে নিক্ষেপ করেছিল। হাজার বছর পরে আলাদীন তাকে মুক্ত করেছে। এখন আলাদীন তার মালিক। সে যা বলবে, সে তাই করবে। যা চাইবে তাই হাজির করবে। আলাদীন দৈত্যকে পরীক্ষা করার জন্য বলল, আমার কুঁড়েঘরকে প্রাসাদ বানিয়ে দাও, আমার মাকে রাজরানীর মতো পোশাকে সজ্জিত করো। আর আমাদের জন্য দুনিয়ার সব ভালো ভালো খাবার এনে দাও। ‘জো হুকুম মালিক’- বলে দৈত্য চলে গেল। আলাদীন চেরাগ হাতে নিয়ে বাড়ির দিকে রওনা করল। হঠাৎ দেখল জীর্ণ জামার পরিবর্তে তার পরনে আছে মনি-মুক্তা খচিত রাজপোশাক। বাড়ি ফিরে সে তার কুঁড়েঘর খুঁেজে পেল না। সেখানে দাঁড়িয়ে রয়েছে বিশাল এক অট্টালিকা। ফটকে দাঁড়িয়ে শিরস্ত্রাণ পরিহিত শান্ত্রী-সেপাই। তাকে দেখে তারা কুর্ণিশ করে দ্বার খুলে দিল। বাড়ি ভেতরে গিয়ে সে দেখল তার মা রাজরানীর মতো পোশাক পরে শানদার এক আসনে বসে আছেন। কয়েকজন দাসী তার খেদমতে ব্যস্ত। তার সামনে রয়েছে দুনিয়ার সব দামি দামি ফলের সমাহার। এ সময় দৈত্য এসে বলল, ‘এ সবকিছুর মালিক আপানি। এরা সবাই আপনার খেদমতগার। আর আমি আপনার নফর, সব হুকুম তামিল করব। যখন প্রয়োজন মনে করবেন, ওই চেরাগে ঘঁষা দিলেই গোলাম হাজির হয়ে যাবে জনাব’। দৈত্য চলে গেল।
অলৌকিক ক্ষমতার সে চেরাগ কোনোকালে পৃথিবীতে ছিল কিনা কেউ জানেনা। তবে, বর্তমানে কিছু ঘটনা দেখেশুনে মনে হচ্ছে, আলাদীনের চেরাগ বোধকরি ভিন্ন কোনো রূপে বাংলাদেশে আবির্ভূত হয়েছে; যার স্পর্শে একদা কপর্দকহীন ভবঘুরেরা রাতারাতি বনে যাচ্ছে ধনকুবের। আধুনিক আলাদীনের এ চেরাগ রয়েছে রাজনৈতিক ক্ষমতার মধ্যে, সরকারি বিভিন্ন দপ্তরে চাকরির চেয়ারে, ব্যবসা-বানিজ্যসহ নানাস্তরে। যারা সে চেরাগের সন্ধান পায়, তাদের আর পেছন ফিরে তাকাতে হয় না। ওটার কেরামতিতে একেকজন রাশি রাশি টাকা-কড়ি, প্রাসাদোপম বাড়ি, লেটেস্ট মডেলের গাড়ির মালিক, অফুরন্ত ব্যাংক ব্যালেন্সের মালিক বনে যান।
এই কলামের গত কিস্তিতে যেসব বিষয় নিয়ে আলোকপাত করার চেষ্টা করেছিলাম, এবারও তা নিয়ে লিখতে হবে ভাবিনি। দেশে অনয়িম-দুর্নীতি আর লুটপাটের যে মচ্ছব চলছে, তা নিয়ে একের পর এক সংবাদ গণমাধ্যেমে উঠে আসছে। সেসব চা ল্যকর খবর সচেতন ব্যক্তিদের মনে শঙ্কার জন্ম দিচ্ছে- যেভাবে লুটপাট চলছে, তাতে দেশের অর্থনীতি উইপোকার ঢিবির মতো হয়ে যায় কি না। এখানে এখন প্রতিনিয়ত বেরুচ্ছে একেকজন অর্থদস্যুর কাহিনী। মনে পড়ছে মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর কথা। স্বাধীনতার পর দেশে চরম অর্থনৈতিক লুটপাট ও দুর্নীতির পরিপ্রেক্ষিতে তিনি ওই লুটেরাদের আখ্যায়িত করেছিলেন, ‘নিখিল বাংলা লুটপাট সমিতি’র সদস্য বলে। আজ যদি তিনি বেঁচে থাকতেন তাহলে কী বলতেন জানি না।
বলছিলাম আধুনিক আলাদীনদের কথা। অদৃশ্য চেরাগের বদৌলতে বাপে খেদানো মায়ে তাড়ানো ভ্যাগাবন্ডরা রাতারাতি আঙুল ফুলে কলাগাছ নয়, রীতিমতো বনে যাচ্ছে বটগাছ। তেমন এক আলাদীনের খবর বেরিয়েছে গত ১৫ সেপ্টেম্বরের পত্রিকাগুলোতে। নাম তার নূরুল ইসলাম। জন্মস্থান ভোলা থেকে ভাগ্যান্বেষণে এসেছিল কক্সবাজারের টেকনাফে। ২০০১ সালে দৈনিক ১৩০ টাকা মজুরির ভিত্তিতে সে যোগ দিয়েছিল টেকনাফ স্থলবন্দরের কম্পিউটার অপারেটরের পদে। ব্যস, ওই চাকরিকেই সে বানিয়ে ফেলল ‘জাদুই চেরাগ’। সেটার অলৌকিক ক্ষমতায় এখন সে ৪৬০ কোটি টাকার সম্পদের মালিক! বেশিদিন সে চাকরি করেনি। ২০০৯ সালে চাকরি ছেড়ে নেমে পড়েছিল অবৈধ কারবারে। চাকরিতে থাকাবস্থায় সে রপ্ত করে নিয়েছিল চেরাগে ঘঁষা দেওয়ার কায়দা। চোরাকারবার, শুল্ক ফাঁকি, অবৈধ পণ্য খালাস, দালালির কৌশল আয়ত্ব করে সে বনে গিয়েছিল টেকনাফ বন্দরের বাপ-মা। বন্দরের অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারি তার ভয়ে তটস্থ থাকত। নিচ থেকে ওপর মহল পর্যন্ত ছিল তার যোগাযোগ। গড়ে তুলেছিল একটি চক্র। ওই চক্রের মাধ্যমে সে নিয়ন্ত্রণ করত সবকিছু। মিয়ানমার থেকে কাঠ, শুকনো বরই আচার ও মাছে আমদানির আড়ালে চলত তার অবৈধ পণ্যের ব্যবসা। এসবের সাথে ইয়াবা ব্যবসাতো ছিলই। এছাড়া টেকনাফ বন্দরের ট্রাকস্ট্যান্ড, বন্দর লেবার ও জাহাজ আগমন-নির্গমনও সে নিয়ন্ত্রণ করত। তার চক্রের পনের সদস্য পনের এসব অপকর্ম সংঘটিত করত। আর সবকিছু সমন্বয় করত ওই নূরুল ইসলাম। গত ১৪ সেপ্টেম্বর রাতে র্যাব তাকে রাজধানীর মোহাম্মদপুর থেকে গ্রেফতার করেছে। পরদিন কারওয়ান বাজারস্থ র্যাবের কার্যালয়ে মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক গণমাধ্যমকে জানান, নূরুল ইসলাম তার অর্জিত অবৈধ অর্থে রাজধানী ঢাকায় ছয়টি বাড়ি ও ১৩টি প্লট কিনেছে। এ ছাড়া সাভার, টেকনাফ, সেন্টমার্টিন, ভোলাসহ বিভিন্ন জায়গায় তার নামে-বেনামে রয়েছে জমি, প্লট, বাগানবাড়ি। তার সম্পদের পরিমাণ প্রায় ৪৬০ কোটি টাকা। দেশের বিভিন্ন ব্যাংকে নূরুল ইসলামের নামে-বেনামে রয়েছে ১৯টি একাউন্ট। গ্রেফতারের সময় র্যাব তার কাছ থেকে উদ্ধার করেছে তিন লাখ ৪৬ হাজার ৫০০ টাকা মূল্যমানের জালনোট, মিয়ানমারের তিন লাখ ৮০ হাজার মূল্যমানের মুদ্রা, চার হাজার ৪০০ পিস ইয়াবা ট্যাবলেট এবং বাংলাদেশি দুই লাখ এক হাজার ১৬০ টাকা। সে তার অবৈধ আয়ের উৎসের ওপর বৈধতার মোড়ক লাগানোর জন্য বেশ কয়েকটি বানিজ্যিক প্রতিষ্ঠানও গড়ে তুলেছিল।
দৈনিক ১৩০ টাকা মজুরির একজন কর্মচারির মাত্র কুড়ি বছরে এই রীতিমতো ধনকুবের বনে যাওয়ার ঘটনা গল্পের মতো শোনালেও তা যে সত্য তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে, সবচেয়ে আশ্চর্যজনক বিষয় হলো, নিম্ন পর্যায়ের ওই কর্মচারিটি টেকনাফে এতসব করছিল, আর সেখানকার কর্মকর্তারা কিছুই টের পেলেন না! এখন তারা কেউ কেউ অবলীলায় অস্বীকার করছেন নূরুল ইসলামকে চেনার কথা। সমকালের খবরে বলা হয়েছে, তাকে স্থানীয়ভাবে সবাই ‘বন্দর নূরুল ইসলাম’ নামেই চেনে। স্থানীয় অধিবাসীরা জানিয়েছেন, সে টেকনাফ কাস্টমস কার্যালয়ের কোনো কর্মচারী না হলেও বন্দর-কাস্টমসে সবকিছু হতো তার ইশারাতেই। বন্দরের কর্মকর্তারা পত্রিকাটিকে বলেছেন, ওই নামে কাউকে তারা চেনেনই না। তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, নূরুল ইসলাম অফিসগুলোতে যেভাবে প্রভাব বিস্তার করেছিলেন, তাতে মনে হয়েছির সে-ই বন্দরের সবকিছু।
এমন দাপুটে একজন মানুষের নাম বন্দরের কর্মকর্তারা জানেন না, তার কর্মকান্ড সম্বন্ধে অবগত নন, এ কথা কী বিশ্বাসযোগ্য? ধারণা করাটা অমূলক নয় যে, তাকে সবাই চিনত, জানত, সম্পর্ক ছিল এবং আন্ডার দ্য টেবিল লেনদেন ও হয়তো ছিল। কেননা, বন্দরে অবৈধ কাজ কারবার চালাতে গেলে সেখানকার কর্মকর্তাদের না জানিয়ে, না খুশি করে কিছু করা সম্ভব এটা বিশ্বাসযোগ্য নয়। এখন নূরুল ইসলামের সময় খারাপ। তাই এতদিন সে যাদের সাথে সখ্য বজায় রেখে চলেছে, তার দেওয়া উপঢৌকন যাদের জীবনযাপনে জৌলুষ বৃদ্ধি করেছে, তারা এখন পিটটান দিয়েছেন। তাকে না চেনার ভান করছেন। এমনটাই স্বাভাবিক। বিশেষ করে আন্ডার ওয়ার্ল্ডে। বিপদে যে পড়ে তার পাশে কেউ থাকে না। এমন কি তার সাথে পূর্বপরিচয় ছিল- এটাও কেউ স্বীকার করতে চায় না।
নূরুল ইসলামরা কিন্তু একজন নয়। এমন হাজারো নূরুল ইসলাম লুকিয়ে আছে আমাদের সমাজে। কেউ সরকারি দপ্তরে, কেউ রাজনৈতিক দলে। কেউ সরকারি দপ্তরের কুরসির অপব্যবহার করে বনে যাচ্ছে শত কিংবা হাজার কোটি টাকার মালিক। আবার রাজনৈতিক দলে নাম লিখিয়ে বিত্ত-বৈভবে ভরা ভাদরের নদীর মতো ফুলেফেঁপে উঠছে কেউ কেউ। অনেকে আফসোস করে বলেন, সমাজে সৎ মানুষ ধীরে ধীরে বিলুপ্ত প্রজাতিতে পরিণত হচ্ছে। জায়গা দখল করে নিচ্ছে অসৎ, চোর জোচ্চোর, বাটপাররা। তাদের দাপট এখন প্রচন্ড। দুর্নীতি নিয়ে হামেশাই কথাবার্তা হচ্ছে। ‘অতন্দ্র প্রহরীর’ মতো দন্ডায়মান আছে দুদকসহ বিভিন্ন সংস্থা। কিন্ত দুর্নীতি কমার কোনো লক্ষণ নেই। কমবে কীভাবে? কখনো কখনো দেখা যায় যারা দুর্নীতির বিরুদ্ধে আইন প্রয়োগ করবে, তারই সে জলে নেমে সাাঁতার কাটছে। ১৫ সেপ্টেম্বর সমকালে প্রকাশিত হয়েছে একটি অর্থ আত্মসাৎ মামলার আসামিকে বাঁচাতে সিআইডির এক তদন্ত কর্মকর্তার অপকীর্তির খবর। একটি জুট মিলের তহবিল আত্মসাতের মামলার তদন্ত ভার পড়ে সিআইডির ওপর। যে অডিট ফার্ম ওই প্রতিষ্ঠানের অডিট করে অর্থ কেলেংকারির বিষয়টি উদঘাটন করেছে, সিআইাডর ওই কর্মকর্তা কয়েকজন সঙ্গীসহ সেই ফার্মের ব্যবস্থাপনা অংশীদারকে অস্ত্রের মুখে লিখে দিতে বাধ্য করেছে, ওই কোম্পানির কোনো অডিট হয়নি, রিপোর্টটি ভূয়া। যার বিরুদ্ধে অভিযোগ তিনি রাজনৈতিক পরিচয়ের একজন আলাদীন। তারও হাতে ছিল চেরাগ। কর্পদকহীন অবস্থায় ঢাকায় এসে ভবঘুরে জীবন যাপনের পর দল ক্ষমতায় এল বনে যান শিল্পপতি। এমন দৃষ্টান্তের অভাব নেই। ক্ষমতাধর ব্যক্তির বাসায় ফাইফরমাশ খাটা যুবকটিও ওই চেরাগের বদৌলতে বনে গেছেন কেউকেটা। ডাকসাইটে নেতা-আমলারাও তাকে জমা-খরচ দিতেন। বিশেষ একটি সেক্টরের ‘মোগল’ হয়ে বসা ব্যক্তিটির সুদিন অবশ্য ফুরিয়েছে অনেক আগেই। কয়েদখানা ভ্রমণ শেষে এখন আস্তানা গেড়েছেন বিদশে। এমনই হয়। অবৈধ কায়কাবারের পরিণতি ভালো হয় না। সাম্রাজ্যের পতন ঘটে। যেমন ঘটেছে টেকনাফের নূরুল ইসলাম, রিজেন্টের সাহেদ, যুবলীগের পাপিয়া-খালেদ-সম্রাটের। এদের প্রাসাদের ভিত্তি নড়বড়ে হয়। তাই একটু ঝড়েই তা মুখ থুবড়ে পড়ে। কিন্তু তারপরও ওই চেরাগ হাতানোর চেষ্টার কমতি নেই। এক সাহেদের হাত থেকে সেটা যায় আরেক সাহেদের হাতে । নূরুল ইসলামের হাত ঘুরে সেটা হয়তো যাবে অন্যকোনো ইসলামের হাতে। যতদিন চেরাগের দৈত্যকে বড় কোনো ওঝা (এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্র) বাগে না আনতে পারবে, ততদিন চেরাগের হাত বদল চলতেই থাকবে। আর আমরা নব্য আলাদীনদের কাহিনী পত্রিকায় পড়ে বিস্ফারিত নয়নে প্রশ্ন করতে থাকব- আর কতদিন চলবে এভাবে?
লেখক: সংবাদিক ও রাজনীতি বিশ্লেষক।