দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন চাকরিচ্যুত ব্যাংকাররা!

প্রকাশ : 2022-02-01 13:38:07১ |  অনলাইন সংস্করণ

  নিউজ ডেস্ক   

দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন চাকরিচ্যুত ব্যাংকাররা!

ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স ইনভেস্টমেন্ট অ্যান্ড কমার্স [আইএফআইসি] ব্যাংকে প্রায় ২৬ বছর ধরে কাজ করেছেন আফছারুল ইসলাম [ছদ্মনাম]। হঠাৎ এইচআরডি [মানবসম্পদ উন্নয়ন বিভাগ] থেকে ডেকে বলা হলো, ‘আপনাকে পদত্যাগ করতে হবে।’ কারণ জানতে চাইলে বলা হয়, ‘তেমন কিছুই না। যাদের বেতন বেশি তাদের মধ্যে ব্যাংক কিছু কর্মী ছাঁটাই করবে— ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে।’

কিছুদিন পর ডেকে বলা হলো, স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করলে সব সুযোগ-সুবিধা পাবেন। যদি চাকরিচ্যুত হন তাহলে কিছুই পাবেন না। পরে জানলাম, আমার মতো প্রায় ২০০ কর্মীকে একই কথা বলা হয়েছে। এভাবে চতুর্থবার বলার পর বাধ্য হয়ে ২০২০ সালের এপ্রিলে করোনার প্রাদুর্ভাবের মধ্যে পদত্যাগ করি।

আইএফআইসি ব্যাংক থেকে পদত্যাগে বাধ্য হওয়া এ কর্মকর্তা আরও বলেন, মহামারির মধ্যে চাকরি হারিয়ে অনেকটা অনিশ্চয়তার মধ্যে চলছে জীবন। বাংলাদেশ ব্যাংকে অভিযোগ করেও কোনো সমাধান পাইনি। গত সেপ্টেম্বরে চাকরিচ্যুত বা পদত্যাগে বাধ্য হওয়া কর্মীদের চাকরিতে পুনর্বহালের নির্দেশ দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কিছুটা আশার আলো দেখতে শুরু করলাম। নিয়ম মেনে আবেদনও করি। কিন্তু চার মাস পার হচ্ছে, এখনও ব্যাংক থেকে কোনো সাড়া পাইনি।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকসহ সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের দ্বারে দ্বারে ঘুরছি কিন্তু কোনো কিছুই হচ্ছে না। সবশেষ বাংলাদেশ ব্যাংকের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, তারা ব্যাংকগুলোকে চিঠি দিয়েছেন। যদি না মানে তাহলে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে— বলেন ভুক্তভোগী ওই ব্যক্তি।

আইএফআইসি ব্যাংকের মতো মহামারি করোনার সময় বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ১২ কর্মকর্তাকে ছাঁটাই, ২০১ কর্মকর্তাকে অপসারণ এবং ৩০ কর্মকর্তাকে বরখাস্ত করা হয়েছে বলে জানা গেছে।

বেসরকারি যমুনা ব্যাংকের বিরুদ্ধেও একই অভিযোগ উঠেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী ছাঁটাই হওয়া কর্মকর্তারা পুনর্বহালের আবেদন করলেও এখন পর্যন্ত কোনো সাড়া দেয়নি ব্যাংকটি।

চাকরিচ্যুত হওয়া যমুনা ব্যাংকের এমন এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, গত বছর কোনো কারণ ছাড়াই আমাদের পদত্যাগ করতে বলেন ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। তাদের নির্দেশনা অনুযায়ী পদত্যাগ না করায় আগস্টে আমাদের চাকরিচ্যুত করা হয়। বিষয়টি একাধিকবার কেন্দ্রীয় ব্যাংককে জানানো হয়েছে। গত ১৬ সেপ্টেম্বর ছাঁটাই হওয়া কর্মীদের পুনর্বহালের নির্দেশনা দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। আমরা সেই নির্দেশনা অনুযায়ী আবেদনও করি। কিন্তু এখন পর্যন্ত আমাদের পুনর্বহাল করা হয়নি। এমনকি ব্যাংকের পক্ষ থেকে যোগাযোগও করা হয়নি।

করোনার মধ্যে চাকরি হারিয়ে আর্থিক ও সামাজিকভাবে খুবই মানবেতর জীবনযাপন করছি— উল্লেখ করে ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, নিয়ন্ত্রণ সংস্থা (বাংলাদেশ ব্যাংক) থেকে বারবার বলা সত্ত্বেও ব্যাংক কর্তৃপক্ষ আমলে নিচ্ছে না। তাহলে আমাদের মতো নিরীহ মানুষ কি বিচার পাবে না? দীর্ঘদিন চাকরি করেছি, আমাদের বিরুদ্ধে অনিয়মের কোনো অভিযোগ নেই। কোনো কারণ ছাড়াই পাঁচ কর্মকর্তাকে একসঙ্গে চাকরিচ্যুত করেছে। সমাধান চেয়ে আমরা ব্যাংকের দ্বারে দ্বারে ঘুরছি। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো সমাধান পাইনি।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্র জানায়, পুনর্বহালের নির্দেশনা সত্ত্বেও এ বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ না নেওয়ায় গত ১৫ ডিসেম্বর কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে আবারও যমুনা ব্যাংককে চিঠি দেওয়া হয়। সেখানে যমুনা ব্যাংক থেকে চাকরিচ্যুত ও পদত্যাগকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের চাকরিতে পুনর্বহালের লক্ষ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের বিআরপিডি সার্কুলার নং-২১/২০২১ এর নির্দেশনার আলোকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বলা হয়।

চিঠিতে ব্যাংকের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আবেদনও সংযুক্ত করা হয়। একই সঙ্গে চাকরিচ্যুত ও পদত্যাগকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে বিধি মোতাবেক চাকরিতে বহাল সংক্রান্ত তথ্য সরেজমিনে যাচাইয়ের লক্ষ্যে ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ের সংশ্লিষ্ট বিভাগে সংরক্ষণের জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়।

কিন্তু এক মাস পার হলেও এখন পর্যন্ত (৩০ জানুয়ারি) যমুনা ব্যাংক কর্তৃপক্ষ চাকরিচ্যুত ও পদত্যাগকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পুনরায় নিয়োগ দেয়নি। এমনকি তাদের সঙ্গে কোনোপ্রকার যোগাযোগও করেনি বলে অভিযোগ ভুক্তভোগী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের।

এ বিষয়ে গত ১৩ জানুয়ারি কেন্দ্রীয় ব্যাংকে চিঠি দিয়েছেন তারা। চিঠিতে বলা হয়, ‘কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে যমুনা ব্যাংক কর্তৃপক্ষ অদ্যাবধি আমাদের পুনরায় নিয়োগ দেয়নি। এমনকি আমাদের সঙ্গে কোনোরূপ যোগাযোগও রক্ষা করেনি। এমতাবস্থায় যমুনা ব্যাংকের চাকরিতে পুনর্বহালের জন্য উপযুক্ত ও কার্যকর দিকনির্দেশনা প্রদানের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হস্তক্ষেপ কামনা করছি।’

স্বেচ্ছায় নাকি জোরপূর্বক পদত্যাগ— কী বলছে বাংলাদেশ ব্যাংক

এদিকে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক পরিদর্শনে উঠে এসেছে, ২০২০ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ২০২১ সালের ৯ আগস্ট পর্যন্ত বেসরকারি ছয় ব্যাংকের তিন হাজার ৩১৩ কর্মকর্তা-কর্মচারী চাকরি ছেড়েছেন। এর মধ্যে ‘স্বেচ্ছায়’ পদত্যাগ করেছেন তিন হাজার ৭০ জন। ১২ কর্মকর্তাকে ছাঁটাই, ২০১ কর্মকর্তাকে অপসারণ এবং ৩০ কর্মকর্তাকে বরখাস্ত করা হয়েছে।

এত কর্মকর্তার ‘স্বেচ্ছায়’ পদত্যাগ ‘অস্বাভাবিক’ বলছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক

কর্মী ছাঁটাই ও পদত্যাগে বাধ্য করা ব্যাংকগুলোর মধ্যে রয়েছে- ইস্টার্ন ব্যাংক, সিটি ব্যাংক, ডাচ–বাংলা ব্যাংক, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক, ব্র্যাক ব্যাংক, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক, যমুনা ব্যাংক ও আইএফআইসি ব্যাংক। করোনাকালীন ডাচ–বাংলা ব্যাংক ও ব্র্যাক ব্যাংকের প্রায় দুই শতাধিক কর্মকর্তাকে অপসারণ করা হয়েছে বলেও জানা গেছে।

‘স্বেচ্ছায়’ পদত্যাগ করা কিছু কর্মকর্তা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শন কর্মকর্তাদের জানান, তাদের পদত্যাগে বাধ্য করা হয়েছে। অন্যদিকে ছাঁটাই, অপসারণ ও বরখাস্ত হওয়া কর্মকর্তাদের নথিপত্র পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের ক্ষেত্রে যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়নি। কারণ দর্শানো নোটিশ বা আত্মপক্ষ সমর্থনেরও সুযোগ দেওয়া হয়নি।

সবকিছু বিবেচনায় নিয়ে ব্যাংকারদের চাকরি সুরক্ষায় উদ্যোগ নেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কারণ ছাড়াই ছাঁটাই বন্ধে ২০২১ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর নির্দেশনা জারি করে নিয়ন্ত্রণ সংস্থা।

নির্দেশনায় বলা হয়, সুনির্দিষ্ট ও প্রমাণিত অভিযোগ ছাড়া কর্মীদের চাকরিচ্যুত করা যাবে না। পাশাপাশি মহামারি কোভিডকালীন ২০২০ সালের ১ এপ্রিল থেকে ২০২১ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকের যে সব কর্মকর্তা-কর্মচারী সুনির্দিষ্ট ও প্রমাণিত কোনো অভিযোগ না থাকা সত্ত্বেও চাকরিচ্যুত হয়েছেন কিংবা চাকরি থেকে পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন, তাদের (আবেদনপ্রাপ্তি সাপেক্ষে) বিধি মোতাবেক চাকরিতে বহালের বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

বিষয়টি নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে লিখিত ও মৌখিকভাবে একাধিকবার নির্দেশনা দেওয়া হলেও অধিকাংশ ব্যাংক তা উপেক্ষা করছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক বারবার নির্দেশনা দিলেও ব্যাংকগুলো কেন তা মানছে না— জানতে চাইলে নিয়ন্ত্রণ সংস্থাটির (বাংলাদেশ ব্যাংক) নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মোহাম্মদ সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘পরিস্থিতি বুঝেশুনেই বাংলাদেশ ব্যাংক নির্দেশনা দিয়েছে। এখন কেউ যদি তা না মানে তাহলে আইন অনুযায়ী তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’