দেশ ভাগের ক্ষত ও মানবিক বিপর্যয় 

প্রকাশ : 2021-06-28 15:34:41১ |  অনলাইন সংস্করণ

  নিউজ ডেস্ক   

দেশ ভাগের ক্ষত ও মানবিক বিপর্যয় 

১৯৪৭ সালের দেশ ভাগের ক্ষত ও মানবিক বিপর্যয়ের স্মৃতি এখনও মানুষের স্মৃতিতে রয়ে গেছে। যারা দেশ ভাগ দেখেছেন তারা কখনও মানব সৃষ্ট এ বিপর্যয়ের কথা ভুলতে পারবেন না।আমার জন্ম ১৯৫৪ সালে, দেশ ভাগের ৮ বছর পর। তাই ১৯৪৭ সালের আগস্টের পরে  দেশ ছেড়ে যাওয়া, বিশেষ করে আমাদের এলাকা বিক্রমপুর থেকে চলে যাওয়া হিন্দুদের স্রোত দেখতে হয়নি। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট শ্রীনগর জমিদার বাড়ির বৈঠকখানার প্রাঙ্গণে (বর্তমানে পাইলট স্কুল এন্ড কলেজ) আয়োজিত অনুষ্ঠানে সভাপতিত্বি করছিলেন প্রভাবশালী একজন হিন্দু, যিনি খাদ্য কমিটির সম্পাদক ছিলেন।

দর্শকদের মাঝ থেকে একজন তাঁকে উদ্দেশ্য করে গোত্র তুলে অশোভন কথা বলেন। পরের দিনই তিনি পরিবারের সদস্যদের নিয়ে কলকাতা চলে যান। আমার ধারণা এমন ঘটনা পূর্ব বাংলার অন্যত্রও হয়তো ঘটেছে। মান সম্মানের ভয়ে অনেক বনেদি হিন্দু পরিবার ১৯৪৭-৪৮ সালে জন্মভূমির ছেড়ে পশ্চিম বঙ্গ ও আসামে চলে যান।

১৯৬০-৬৪ সালে প্রাইমারি স্কুলের ছাত্রকালে দেখেছি অধিকাংশ শিক্ষার্থী হিন্দু ছেলেমেয়ে। যাদের প্রায় সবাই ১৯৬৫ সালের যুদ্ধের পরপর ওপার বাংলায় চলে যায়। আমাদের স্কুলটি একজন হিন্দু ভদ্রলোকের বাড়ির মন্ডপ ঘরে ছিল। বিরাট দিঘীর চারদিকে ২০/২৫ টি হিন্দু পরিবারের বাস ছিল।এসব বাড়ির ৫/৬ জন মেয়ে আমাদের স্কুলে উপরের শ্রেণীতে পড়ত। প্রত্যেকের নাম চেহারা আমার এখনও মনে আছে। তারাও ১৯৬৫ সালের পরে আত্মীয়-স্বজনদের কাছে কেউ কলকাতা, কেউ আসাম-করিমগঞ্জ চলে গেল। ১৯৭১ সালে আমি মুক্তিযোদ্ধার ট্রেনিং নিতে ভারতে যাই। সে সময় একদিন করিমগঞ্জ গিয়েছিলাম। আমি যাবার খবর পেয়ে সহপাঠীরাসহ তাদের পরিবারের অনেকে আমাকে দেখার জন্য ছুটে আসে। বাবা, মা, ভাইদের থেকে পরিবারের কন্যা সন্তানদের এই যে চির বিচ্ছিন্নতা, এটাতো বাংলা ভাগেরই ফল। এসব  মেয়ের মাকে মেয়ের কথা মনে করে কান্না করতে দেখেছি। আঁচলে চোখ মুছতে মুছতে বলত, মেয়েটাকে কত দিন ধরে দেখিনা। মায়ের এ দুঃখবোধও দেশ ভাগের জন্য। বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া কন্যারাও মার জন্য নিরবে অশ্রুপাত করত।

প্রাইমারি স্কুলে আমাদের এক শিক্ষক ‘ললিত মোহন কর’, আমাদের যে কত আদর করতেন তার তুলনা হয় না। মাস শেষে বেতন পেয়েই আমাদের কয়েকজনকে নিয়ে যেতেন বাজারের নামকরা মিষ্টির  দোকান শিব শংকর মিষ্টান্ন ভা-ারে, যেটার মালিক ছিলেন লালা মোহন কুরি নামে একজন সজ্জন ব্যক্তি। স্যার আমাদেরকে বড় বড় রসগোল্লা খাওয়াতেন। সে দোকানটি আজো আছে। এখন তার নাতিরা ব্যবসা চালায়। এখনও ওই মিষ্টির দোকানটির কাছ দিয়ে গেলে স্যারের সেই মিষ্টি খাওয়ানোর স্মৃতি মনে পড়ে। নিজের অজান্তই চোখের পাতা ভিজে ওঠে। বিশাল সাইজের দুটি খাওয়ার পর আমরা ‘আর  খেতে পারব না বললে স্যার বলতেন, ‘আরে খা খা। রসগোল্লা চিনি আর ছানা দিয়া বানায়। যত খাবি তত ব্রেন ভালো হবে”। ললিত স্যারদের দোতলা দালানসহ বাড়ি ,জমি কলকাতায় সমমানের বাড়ি বিনিময়ের শর্তে এক মুসলমান বাটপারে নিয়ে নেয়। কলকাতা গিয়ে স্যার দেখেন পুরোটাই ছিল ধাপ্পা। ললিত স্যার বেঁচে আছেন কি না জানিনা। এই যে একজন মহান শিক্ষকের জীবনে বিপর্যয়- সেটা তো দেশ ভাগেরই কারণে।

প্রথম শ্রেণি থেকে অস্টম শ্রেণি পর্যন্ত আমার সহপাঠি মুকুন্দ ১৯৬৭ সালে কোচবিহার চলে যায়। ২০১৯ সালে বেড়াাতে গিয়ে জানতে পারি ওদের পাড়াার মধ্যে সবচেয়ে বড় ব্যবসায়ী শশি কুন্ডুরা ওখানে গিয়ে আর্থিকভাবে ভাল করতে পারেননি। অথচ শ্রীনগর বাজারের সবচেয়ে বড় কাপড়ের দোকান ছিল তাদের। বড় বড় জমি ছিল তাদের। একান্নবর্তী পরিবারে দৈনিক একমণ চালের ভাত রান্না হতো তাদের বাড়িতে । বছরে একবার মহোৎসব হতো। দূর-দূরান্ত থেকে কত মানুষ আসত কুন্ডু বাড়তে! রাতে হতো কীর্তন। আমি স্বামী বিবেকানন্দের ছবি তাদের বাড়িতে প্রথম দেখি। এমন একটি স্বচ্ছল পরিবারের এই যে পরিণতি তাতো দেশ ভাগের কারণেই।

আমাদের প্রতিবেশি জ্ঞাতি এক দাদা আসামের বড়পেটায় ব্যবসা করতেন। আরেক জ্ঞাতি কাকাও সেখানে হোটেলের মালিক ছিলেন। ১৯৬৫ সালের পর তারা প্রায় শূণ্য হাতে সব ফেলে বড়পেটা ছেড়ে চলে আসতে বাধ্য হন। এ সবই ১৯৪৭ সালের দেশ ভাগের ক্ষত। এমন হাজার হাজার নজির আছে উভয় বাংলা ও আসাম থেকে নিঃস্ব হয়ে ফিরে আসার। 

দেশ ভাগের ফলে আমাদের এলাকার শিক্ষাঙ্গনে বিপর্যয় নেমে আসে। বিক্রমপুরের ৫৫ টি ইংলিশ হাই স্কুলের ৩০ টি বন্ধ হয়ে যায় হিন্দু শিক্ষক ও ছাত্রদের দেশ ত্যাগের কারণে। তবে সব শিক্ষক-ছাত্র ১৯৪৭ সালে চলে যাননি। নাড়ির টানে অনেকে জন্মভিটায় থেকে গিয়েছিলেন। কিন্তু তারা ১৯৫০ সালের দাঙ্গার ফলে দেশ ছাড়তে বাধ্য হন। দাঙ্গার পরে ঢাকায় অনুষ্ঠিত শিক্ষা সম্মেলনে পেশকৃত তথ্যে জানা যায়, পূর্ববঙ্গের ১৫০০ হাই স্কুলের মধ্যে ৫০০ চালু আছে।  শিক্ষাক্ষেত্রের এই ক্ষত কখনও শুকায়নি। ১৯৫০ সালের দাঙ্গার ফলে শুধু স্কুলের নয়, বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের বহু হিন্দু অধ্যাপক দেশ ত্যাগ করেন।

১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পরে ধনী ও আগে থেকেই পেশাগত কারণে যারা পশ্চিম বঙ্গে অবস্থান করছিলেন, তারা পরিবার পরিজন নিয়ে পূর্ববঙ্গ ত্যাগ করেন। ১৯৫০ সালের দাঙ্গার ফলে মধ্যবিত্ত, নিম্মবিত্ত এমন কি গরীব মানুষ দল বেঁধে দেশ ছাড়ে । এ দাঙ্গার কারণে প্রায়  এক লাখ হিন্দু পূর্ব বাংলা ত্যাগ করেন। এ সময় প্রায় সম সংখ্যক মুসলমানও প্রাণ বাঁচাতে পশ্চিমবঙ্গ ও আসাম ছেড়ে চলে আসেন। যারা রিফিউজি পরিচয়ে বিভিন্ন স্থানে আশ্রয় নেয়।
 
দেশত্যাগী হিন্দুরা বাস্তার ঢালে ,উদ্বাস্তু শিবিরে ও কলোনিতে আশ্রয় পায়। এ সব স্থানে আশ্রয়প্রাপ্তরা বহু কষ্টে জীবন ধারণ করে কোনোমতে বেঁচে থাকে। অনেকে, বিশেষ করে শিশুরা নানা রোগ-ব্যাধিতে প্রাণ হারায়। প্রতিভা বসুর “জীবনের জলছবি” স্মৃতিকথায় আশ্রয় শিবিরে তাঁর ঠাকুর মা’র বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুর বিবরণ আমাদের কাঁদায়। বিক্রমপুরের হাঁসাড়ার এক ধনী পরিবারের বৌ ছিলেন তিনি। দুর্গাপূজায় গ্রামের গরীরদের নিমন্ত্রণ করে খাওয়াতেন এবং প্রত্যেককেই শাড়ি উপহার দিতেন।এমন হাজার হাজার মানবিক বিপর্যয়ের খবর আমরা দেশ ভাগের প্রেক্ষাপটে নির্মিত চলচ্চিত্রে, উপন্যাস-গল্পে  দেখতে পাই।

অবিভক্ত বাংলার মুখ্যমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দীর মন্ত্রিসভার সদস্য বসিরহাটের জমিদার খান বাহাদুর এএফএম আবদুর রহমান পরিবার পরিজন নিয়ে ঢাকায় আসেন খালি হাতে। তিনি পাকিস্তান জুট মিলস কর্পোরেশনে জন সংযোগ পরিচালক পদে চাকরি করে শেষ জীবন অতিবাহিত করেন। দেশ ভাগের কারণে অবস্থা সম্পন্ন এমন বহু মানুষের জীবনে দুঃখ কষ্ট নেমে আসে।

অবিভক্ত বঙ্গীয় আইন সভার সদস্য ও প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক আবুল হাশিমের বর্ধমানের বাড়ির বৈঠক ঘরে গুন্ডারা আগুন দেয় ১৯৫০ সালে দাঙ্গার সময়। তিনি ক্ষোভে, দুঃখে বর্ধমানের বাড়ি এবং বিষয়-সম্পত্তি পানির দামে বেঁচে ঢাকায় চলে আসেন এবং নানামুখী সমস্যা নিয়ে বাকি জীবন কাটান।

১৯৫০ সালের পরে দেশত্যাগের হিড়িক পড়ে ১৯৬৪ সালের দাঙ্গা ও ১৯৬৫ সালের যুদ্ধের ফলে। এ সময়ে বহু খ্যাতনামা মানুষকে মোনায়েম খাঁর সরকার দেশ থেকে জোর করে বের করে দেয়। ভাগ্যকূলের জমিদার যদুনাথ রায়কে পুলিশ টেনে হিঁচড়ে গোয়ালন্দগামী স্টিমারে উঠিয়ে দেয়। আর একজন ডাঃ মনমথ নাথ নন্দী, যিনি নন্দী ডাক্তার নামেই ঢাকা ও বিক্রমপুরে সুপরিচিত ছিলেন। তাঁর দুইপুত্র লন্ডনে পড়ত। তারা লন্ডন থেকে গাড়ি চালিয়ে সড়ক পথে ঢাকা আসার সময় পাকিস্তানের লাহোরের লুদিয়ানার কাছে পাকিস্তান আর্মির সাজোয়া বহরের সাথে ঘন কুয়াশার কারণে দুর্ঘটনায় পতিত হন। এক পুত্র, পূত্রবধূ ও কন্যাসহ আহত হয়। টেলিগ্রাম পেয়ে ডাঃ নন্দী স্ত্রী শান্তি নন্দীকে সাথে নিয়ে লাহোর যান ওদের চিকিৎসা করে নিয়ে আসার জন্য। ঠিক এ সময়ে পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধ বাঁধে। যুদ্ধের পর ডাঃ নন্দী পরিবারের সকলকে নিয়ে ঢাকায় ফিরে আসার সময় ইমিগ্রেশনে এসে বাঁধা পান। তাঁকে জানানো হয় পাকিস্তান সরকার তাঁকে বৈরী ঘোষণা করেছে, দেশে প্রবেশ নিষেধ। ডাঃ নন্দী বাকি জীবন জলপাইগুড়িতে কাটান। ডাঃ নন্দী বিক্রমপুর ও ঢাকার মানুষের কল্যাণের জন্য অনেক অবদান রেখেছেন। তিনি ছিলেন প্রকৃত অর্থে একজন জনদরদী চিকিৎসক। তিনি হিন্দুদের দেশত্যাগ করতে নিষেধ করতেন। ১৯৪৩ সালের দূর্ভিক্ষের সময় শ্রীনগর শ্রীনাথ চ্যারিটেবল হাসপাতালে চিকিৎসা সেবা দেয়ার সাথে নিজ অর্থ ব্যয়ে তিনি লঙ্গরখানা খুলে অভূক্ত হাজার হাজার মানুষের খাওয়ার ব্যবস্থা করেছেন। দেবতূল্য এমন মানুষকে গণবিরোধী পাকিস্তান সরকার নিজ দেশে আসতে দেয়নি। এটা ছিল রাষ্ট্রিয় চরম অনাচার।

১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের ফলে ৭.৫ মিলিয়ন শিখ ও হিন্দু পাকিস্তান থেকে ভারতে আসে আর ৭.২ মিলিয়ন মুসলমান ভারত থেকে পাকিস্তান আসে। আসলে ১৯৪৭ সালের দেশভাগ ছিল একটি রাজনৈতিক দূর্ঘটনা। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ রদ করার জন্য যারা আন্দোলন করে বাংলা ভাগ বন্ধ করতে ব্রিটিশদের বাধ্য করেছে, তারাই ১৯৪৭ সালে বাংলা ভাগ করতে ব্রটিশদের পক্ষ নিয়েছে। এটাই ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ট্রাজেডি।

লেখক: বীর মুক্তিযেদ্ধা, সাবেক ছাত্রনেতা।