দুর্নীতির মাষ্টার চরমুগরিয়া মহাবিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ মো. হান্নান মোল্লা

প্রকাশ : 2025-03-14 19:37:51১ |  অনলাইন সংস্করণ

  নিউজ ডেস্ক   

দুর্নীতির মাষ্টার চরমুগরিয়া মহাবিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ মো. হান্নান মোল্লা

দুর্নীতির মাষ্টার হয়ে উঠেছেন মাদারীপুর সদর উপজেলার চরমুগরিয়া মহাবিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ মো. হান্নান মোল্লা। কলেজে কর্মচারী আছে তারপরও তিনি কলেজের অধ্যক্ষ হয়ে একই সাথে হিসাবরক্ষক ও কোষাধ্যক্ষের কাজ করছেন। কলেজের আয় ব্যয় সংক্রান্ত যাবতীয় নথিপত্র তিনি নিজের কাছে রাখেন। অধ্যক্ষ মো. হান্নান মোল্লা দুর্নীতি করে কলেজের লক্ষ লক্ষ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে তার প্রমান পেয়েছে কলেজের বিশেষ নিরীক্ষা কমিটি।

জানা যায়, ১ অক্টোবর ২০১৩ সালে অধ্যক্ষ হিসাবে মো. হান্নান মোল্লা চরমুগরিয়া কলেজে যোগদান করেন। যোগদানের পর থেকেই নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে তিনি নিজের ইচ্ছামত কলেজ পরিচালনা শুরু করেন। কলেজের হিসাবরক্ষক ও কোষাধ্যক্ষের কাছ থেকে হিসাবের খাতাপত্রসহ সকল নথি তার নিজের কাছে নিয়ে নেন। এরপর থেকে কলেজের আয় ব্যয়ের হিসাব তিনি ছাড়া আর কেউ জানে না। ২০১৮ সালে গঠন করা হয় বিশেষ নিরীক্ষা কমিটি। তৎকালীন মাদারীপুর জেলা প্রশাসক ছিলেন মো. ওয়াহিদুল ইসলাম। তিনিই ছিলেন চরমুগরীয়া কলেজের গভর্নিংবডির সভাপতি। মাদারীপুরে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক হিসাবে কর্মরত উপসচিব মো. আজহারুল ইসলামকে আহŸায়ক ও চরমুগরীয়া কলেজের সহকারী অধ্যাপক বেনজীর আহম্মদকে (মারা গেছে) সদস্য সচিব করে ৪ সদস্যের বিশেষ নিরীক্ষা কমিটি গঠন করে দেন তিনি। ৯০ দিনের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দেয়ার কথা থাকলেও অধ্যক্ষের অসহযোগীতা ও করোনার কারণে তদন্ত শেষ করে ২০২১ সালের এপ্রিল মাসে তৎকালীন জেলা প্রশাসক ও কলেজের গভর্নিংবডির সভাপতি মোসা. রহিমা খাতুনের কাছে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করে বিশেষ নিরীক্ষা কমিটি।

২০১৮ সালের আগষ্ট মাসে গঠন করা বিশেষ নিরীক্ষা কমিটির ২০১৩ সালের অক্টোবর থেকে ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত কলেজের আয় ব্যায়ের হিসাব নিরিক্ষার প্রতিবেদন ২০২২ সালের ২১ এপ্রিল জমা দেন। এই প্রতিবেদনে অধ্যক্ষ মো. হান্নানের অনিয়মের যে চিত্র উঠে এসেছে-
২০১৩ সালের ১ সেপ্টেম্বর থেকে ২০২১ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত কলেজের আয় ছিল ৪ কোটি ৭৫ লাখ ৮৩ হাজার ২৫৪ টাকা। কলেজের ১, ২ ও ৩ নং ব্যাংকের হিসাবে জমা দেখা যায় ২ কোটি ২০ লাখ ৯৩ হাজার ৩১৩ টাকা ৫৮ পয়সা। এছাড়া অধ্যক্ষের একক স্বাক্ষরে পরিচালিত কলেজের ৪র্থ নং ব্যাংক এ্যাকাউন্ডে জমা হয় ১ কোটি ৫০ লাখ ৩৬ হাজার ৩৮১ টাকা। বাকী ১ কোটি ৪ লাখ ৫৩ হাজার ৫৫৯ টাকা ৪২ পয়সার কোন হদিস পায়নি নিরিক্ষা কমিটি। 

অধ্যক্ষ মো. হান্নানের একক স্বাক্ষরে পরিচালিত এ্যাকাউন্ডে জমাকৃত টাকা গভনিং বডির অনুমতি ছাড়া নিজের ইচ্ছেমত খরচ করেছেন। কলেজের আয় ব্যায়ের হিসাবের খাতা কলেজ সংশ্লিষ্ট কোন কর্মচারির কাছে না রেখে অধ্যক্ষ নিজ জিম্মায় রাখে এবং কোষাধ্যক্ষের দায়িত্বও নিজেই পালন করেন।

৩ জুলাই ২০১৭ সালে কলেজের পরীক্ষার ফি ফান্ড জমাকৃত এ্যাকাউন্ডের হিসাব নং ০১০০০৩৮৯২৭৬৯ হতে ০৮০১২২৩ নং চেকের মাধ্যমে অধ্যক্ষ নিজ নামে ৭ লাখ টাকা উত্তোলন করে যা কলেজের কোন আয় ব্যায়ের হিসাব খাতায় পাওয়া যায় নি।

কলেজের আয় থাকলেও ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত শিক্ষক কর্মচারিদের বেতন ভাতাদি বাবদ বকেয়া পরে ৪৬ লাখ ৪৮ হাজার টাকা।
অধ্যক্ষ মো. হান্নান মোল্লা কলেজ ক্যাম্পাসে ফ্রি আবাসন ভোগ করলেও বাড়ি ভাড়া বাবদ নিয়েছে প্রায় ১ লাখ ২৮ হাজার টাকা। এছাড়া অধ্যক্ষের বাসভবনের বিদ্যুৎ বিল নিয়েছেন ৪০ হাজার ৫শত টাকা। ডিস বিল বাবদ নিয়েছেন ১৬ হাজার ২ শত টাকা।

২০১৩ সাল থেকে ২০১৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত কলেজের উন্নয়ন খাতে ব্যায় দেখিয়েছেন ৮ লাখ ৫৩ হাজার ১ শত ৮ টাকা। কিন্তু গভানির্ং বডির অনুমোদন আছে মাত্র ১০ হাজার টাকার। বাকি টাকা তিনি নিজের ইচ্ছামত খরচ করেছেন। এই কাজের ব্যায়ের কোন ভাউচার কলেজ কর্তৃপক্ষের কাছে নেই।

২০১৩ সাল হতে ২০২১ সাল পর্যন্ত পরীক্ষা কেন্দ্র ফি বাবদ আয় হয়েছে ৫৮ লাখ ৯২ হাজার ৫১ টাকা। কিন্তু খরচ দেখিয়েছেন ৮৫ লাখ ৪০ হাজার ৩ শত ৩৪ টাকা। অতিরিক্ত টাকা তিনি কমিটির অনুমতি ছাড়া কলেজের সাধারণ ফান্ড থেকে তুলে নিয়েছেন। সাধারণ ফান্ড থেকে টাকা তুলে নেয়ার কোন বৈধতা নেই অধ্যক্ষের।

করোনাকালীন সময় শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে পরীক্ষার ফি নেয়ার অনুমতি না থাকায় পারিশ্রমিক ছাড়া শিক্ষার্থীদের খাতা দেখে দিয়েছে শিক্ষকরা। কিন্তু এ্যাসাইমেন্ট সম্মামীর নামে অধ্যক্ষ ৪৫ হাজার টাকা তুলে নিয়েছেন এবং কর্মচারীদের ১ লাখ ৪৯ হাজার ৮ শত টাকা দিয়েছেন।অধ্যক্ষ কলেজের পরিত্যাক্ত বিপুল পরিমান মালামাল বিক্রি করে দিয়েছেন কমিটির অনুমতি ছাড়া। এখানেও দুর্নীতি করেছে বলে নিরিক্ষা কমিটি সন্দেহ প্রকাশ করেছে তাদের রিপোর্টে। এছাড়া হিসাব খাতায় দেখা যায় ৩৩ লাখ ২৪ হাজার ৯৬ টাকার মনোহারীর মালামাল ক্রয় করা হয়েছে। তার মধ্যে ২ লাখ ৪০ হাজার ৬ শত ৮৯ টাকার মালামাল অধ্যক্ষ নিজেই কিনেছেন।

কলেজ ক্যাম্পাসে বসবাস করেও অধ্যক্ষ বাসভবন থেকে কলেজে যাতায়াতের টাকাও কলেজ ফান্ড থেকে নিয়েছেন তিনি। কলেজ শিক্ষার্থীদের কাজ থেকে প্রাকটিক্যাল পরীক্ষায় অতিরিক্ত ফি আদায় করে অধ্যক্ষ একাই নিয়েছেন ৬ লাখ টাকা। শিক্ষার্থীদের প্রশংসাপত্র দিয়ে হাতিয়ে নিয়েছেন ৬০ হাজার টাকা। শিক্ষার্থীদের বিষয় ও বিভাগ পরিবর্তন করার জন্য ফি নিয়ে হাতিয়ে নিয়েছেন ৮০ হাজার টাকা।

অধ্যক্ষ মো. হান্নান মোল্লার বিরুদ্ধে বিশেষ নিরীক্ষা কমিটি কোটি কোটি টাকার অনিয়ম পেলেও বহাল তবিয়তে নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে এখনও অধ্যক্ষ হিসাবে কলেজ পরিচালনা করছেন তিনি। জেলা প্রশাসক বিশেষ নিরীক্ষা কমিটির রিপোর্টসহ অধ্যক্ষ মো. হান্নানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ করে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের সচিব বরাবর পাঠালেও অদৃশ্য কারনে তার বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা গ্রহন করেনি তারা।

হিসাব রক্ষক মিজানুর রহমান জানান, আমি এই কলেজের নিয়োগপ্রাপ্ত হিসাব রক্ষক। তিনি (অধ্যক্ষ) আসার পর থেকে আমাকে হিসাব দেখতে বা লেখতে দেননা। উনি একাই হিসাবে লেখেন, খরচপাতি করেন আমরা এর কিছুই জানতে পারি না। আমাদের ধারনা অধ্যক্ষ যে হিসাব করেছে তার মধ্যে অনেক নয় ছয় আছে। প্রয়োজন ছাড়া বিভিন্ন উন্নয়ন দেখিয়ে টাকা নয় ছয় করেছে। অথচ আমাদের বেতন ভাতা দেয়নি। আমাদের অর্থাভাবে রেখে তিনি উন্নয়নের নামে নয় ছয় করছে আমরা এর সঠিক বিচার চাই এবং আমার দায়িত্ব আমাকে বুঝিয়ে দেয়াসহ আমাদের (শিক্ষক-কর্মচারীদের) পাওনা টাকা বুঝিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা ব্যবস্থা করা হোক এটাই আমার চাওয়া।

চরমুগরীয়া কলেজের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন শিক্ষক জানান, অধ্যক্ষ হান্নান এই কলেছে জয়েন করার কিছুদিনপর থেকেই সেচ্ছাচারিতা শুরু করেছে। শিক্ষকদের বেতন ভাতা তার ইচ্ছামত দেয়। এ কারণে শিক্ষক ও কর্মচারিদের অনেক টাকা বকেয়া হয়ে গেছে। কোন শিক্ষককেতো মূল্যায়ন করেনই না এমনকি গভনির্ং বডিকেও কোন দাম দেয় না। আর কর্মচারীদের নিজের চাকর মনে করে। এভাবেই তিনি কলেজ চালাচ্ছেন। এছাড়া তিনি কলেজের লাখ লাখ টাকা লুটপাট করে কলেজ ধ্বংশ করার পায়তারা করছে। আমরা অধ্যক্ষ হান্নানের অপসারণ চাই। সেই সাথে অধ্যক্ষের লুট করা টাকা আদায়সহ তার দুর্নীতির বিচার চাই।

মাদারীপুর জেলা প্রশাসক মোসা. ইয়াসমিন আক্তার বলেন, বিশেষ নিরীক্ষা কমিটির তদন্ত রিপোর্ট পাওয়ার পর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের সচিব স্যারের কাছে পাঠিয়েছি। আমরা কলেজের অধ্যক্ষ বা শিক্ষকদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নিতে পারি না। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিবে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।

ঢাকা বোর্ডের সচিব প্রফেসর ড. মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, এ বিষয়ে আমাদের চেয়ারম্যান মহোদয়ের সাথে কথা বলেন। তিনিই বোর্ডের সর্বসর্বা। ঢাকা বোর্ডের চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. খন্দকার এহসানুল কবির এর সাথে তার অফিসিয়াল মোবাইল নম্বরে যোগাযোগের চেষ্টা করে তাকে পাওয়া যায় নাই।