দিল্লিতে মোদীর সঙ্গে পুতিনের বৈঠক থেকে দুই দেশ কী পেল?

প্রকাশ : 2025-12-06 10:34:11১ |  অনলাইন সংস্করণ

  নিউজ ডেস্ক   

দিল্লিতে মোদীর সঙ্গে পুতিনের বৈঠক থেকে দুই দেশ কী পেল?

দু’দিনের ভারত সফরে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় দিল্লির পালমে ইন্দিরা গান্ধী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নামেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন।সেখানে তাকে স্বাগত জানাতে প্রোটোকল ভেঙে হাজির হয়েছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। ঊষ্ণ অভ্যর্থনায় স্বাগত জানানো হয় তাকে।

এরপর কিছু আনুষ্ঠানিকতা এবং প্রেসিডেন্ট প্রাসাদে নৈশভোজ শেষে দিল্লির হায়দরাবাদ হাউজে ২৩তম ভারত-রাশিয়া শীর্ষবৈঠকে যোগ দেন দুই নেতা।

ইউক্রেইন যুদ্ধের পর রাশিয়াকে পশ্চিমাদের কূটনৈতিকভাবে একঘরে করার চেষ্টার মধ্যে ভারতের পুতিনের এই সংবর্ধনা পশ্চিমা দেশগুলোর জন্য এক শক্তিশালী বার্তা। কিন্তু বাস্তবে পুতিনের এই সফর আর মোদীর সঙ্গে তার বৈঠক থেকে দুই দেশ কী পেল?

আড়ম্বর থাকলেও বড় চুক্তি হয়েছে কম:

প্রেসিডেন্ট পুতিনকে যে আড়ম্বরের সঙ্গে স্বাগত জানানো হয়েছে রাশিয়ানরা সেটি পছন্দ করেছে।শুক্রবার সকালে ভারতের রাষ্ট্রপতি ভবনে ২১ বার তোপধ্বনি ও গার্ড অব অনার দিয়ে পুতিনকে সম্মান জানানো হয়। ৩৪০ টি কক্ষের একটি প্রাসাদে তাকে রাখা হয়।

তবে প্রাসাদে যত কক্ষ ছিল, চুক্তির তালিকা তত দীর্ঘ নয়। তারপরও যেসব চুক্তি হয়েছে তা দুই দেশের জন্য তাদের বিশেষ ও অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত কৌশলগত অংশীদারত্বের কথা ফলাও করে বলার মতো যথেষ্ট।

এর মধ্যে রয়েছে, রাশিয়া-ভারত অর্থনৈতিক সহযোগিতা কর্মসূচি, গুরুত্বপূর্ণ খনিজ ও সাপ্লাই চেইনসংক্রান্ত চুক্তি। পাশাপাশি রাশিয়ার কালুগা অঞ্চলে একটি যৌথ ফার্মাসিউটিক্যাল কারখানা নির্মাণের চুক্তি।

অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে এসেছে তেলের প্রসঙ্গ। রাশিয়া জানিয়েছে, তারা ভারতে ‘নিরবচ্ছিন্নভাবে’ জ্বালানি সরবরাহ করবে। তবে এ বিষয়ে বিস্তারিত কিছু বলা হয়নি।

তাতে মনে হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পের শুল্কের চাপের মুখে বল এখন ভারতের কোর্টে। ভারতই এ বিষয়ে পরবর্তী করণীয় নিয়ে সিদ্ধান্ত নেবে। এরপর এসেছে রাশিয়ার অস্ত্র ও প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার প্রসঙ্গ।

পুতিন ভারত সফরের আগে রাশিয়ার কাছ থেকে ভারতের স্টেট অব দ্য আর্ট জঙ্গিবিমান এবং আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা কিনছে কিনা তা নিয়ে গুঞ্জন শোনা গিয়েছিল।

তবে শেষ পর্যন্ত কোনও প্রতিরক্ষা চুক্তির ঘোষণা আসেনি। যুদ্ধবিমান কেনা কিংবা এস-৪০০ নিয়েও কোনও ঘোষণা আসেনি। তবে জাহাজনির্মাণ শিল্প ও বেসামরিক পারমাণবিক শক্তি নিয়ে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্র এবং রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে ভারত ভারসাম্য রক্ষা করতে চেয়েছে- এটি হয়ত তারই লক্ষণ।

পুতিনের পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ক উপদেষ্টা ইউরি উশাকভ বলেছেন, মোদী-পুতিন রুদ্ধদ্বার মুখোমুখি বৈঠকই ছিল সফরের মূল পর্ব। সেখানেই দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি নিয়ে সবচেয়ে জরুরি, সবচেয়ে স্পর্শকাতর ও গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা হয়েছে।

বাণিজ্য ছিল কেন্দ্রবিন্দু:

ভারতের রাজধানী দিল্লির বিমানবন্দরে বিরল কূটনৈতিক সৌজন্যে মোদীর আলিঙ্গনে পুতিনকে যেভাবে স্বাগত জানানো হয়েছে তা ভারতের রাশিয়ার প্রতি দীর্ঘদিনের অংশীদারিত্ব এবং পুতিনের সঙ্গে বন্ধুত্বেরই প্রকাশ।

তবে এরপরও চুক্তির ক্ষেত্রে বড় ধরনের কিছু দেখা যায়নি। দুই দেশর মধ্যে বড় ধরনের প্রতিরক্ষা চুক্তি যেমন হয়নি, তেমনি রাশিয়া থেকে ভারতের মূল্যছাড়ে তেল কেনা অব্যাহত রাখা নিয়ে কোনও চুক্তিও হয়নি।

দুই নেতা বক্তব্য রাখার সময় একে অপরের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে কথা বলেছেন। কিন্তু এরপর তারা উল্লেখযোগ্য কোনও বড় চুক্তির ঘোষণা দেননি।

তবে তাদের বক্তব্য থেকে যেটি স্পষ্ট হয়েছে তা হল, এই সফরের মূলে ছিল বাণিজ্য। পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞায় বিপর্যস্ত রাশিয়া এবং যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চ শুল্কের চাপে থাকা ভারত দুই দেশই অর্থনীতি প্রসারের জন্য বিকল্প বাজার খুঁজছে।

ভারত ও রাশিয়া দুই দেশই একে অপরের দেশকে বড় বাজার হিসাবে দেখছে এবং দুই দেশই এ বিষয়ে একমত যে, তাদের অর্থনৈতিক অংশীদারিত্ব কয়েকদশক ধরেই বেশি ভাল যাচ্ছে না।

দু’দেশের বর্তমান বাণিজ্য ৬৮ দশমিক ৭২ বিলিয়ন ডলার, যা ২০২০ সালের ৮ দশমিক ১ বিলিয়ন ডলার থেকে বেশি। আর তা ঘটেছে মূলত রাশিয়ার মূল্যছাড়ে ভারত তেল কেনার কারণে। রাশিয়া চাইছে এই প্রবাহ বজায় থাকুক।

পুতিনের ভারতকে ‘নিরবচ্ছিন্ন জ্বালানি সরবরাহ’ করতে প্রস্তত থাকার বক্তব্যটি মূলত দিল্লিকে হোয়াইট হাউজের কাছে নতি স্বীকার না করে রুশ তেল কেনা অব্যাহত রাখার সিদ্ধান্ত নিতে বলার ক্ষেত্রে মস্কোর এক ধরনের ইঙ্গিত।

রাশিয়ার তেল না কেনার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পের কাছ থেকে চাপে আছে ভারত। এখন ভারত রাশিয়ার তেল কেনা এবং যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একই সময়ে বাণিজ্য চুক্তি করার ক্ষেত্রে ভারসাম্য কি করে বজায় রাখে সেটি দেখার বিষয়।

প্রতিরক্ষা এবং তেলের বিষয়টি ছাড়াও ভারত ও রাশিয়া অবশ্য অন্যান্য খাতে অনেক চুক্তি করেছে। দুই দেশ ১০০ বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্যিক লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে পাঁচ বছরের অর্থনৈতিক কাঠামো সই করেছে।

তাছাড়া, জাহাজ নির্মাণসহ নাবিক প্রশিক্ষণ, নতুন শিপিং লেন, ভিসামুক্ত ভ্রমণ, গুরুত্বপূর্ণ খনিজ ও অন্যান্য আরও বিষয়ে চুক্তি সই হয়েছে।

মোদী বলেছেন ইউরেশিয়ান ইকোনমিক ইউনিয়ন (ইএইইউ)-এর সঙ্গে সম্ভাব্য মুক্ত বাণিজ্য চুক্তিতে অগ্রগতি হয়েছে। এ চুক্তি হলে রাশিয়া ও ভারতসহ অন্যান্য সদস্যদেশ- আর্মেনিয়া, বেলারুশ, কাজাখস্তান ও কিরগিজস্তান নতুন বাজারে প্রবেশাধিকার পাবে।

বড় কোনও চুক্তি না হলেও ভারতের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় রাশিয়ার প্রভাব অটুটই থাকছে। প্রতিরক্ষা সম্পর্ক থাকছে অব্যাহত।

ভারত রাশিয়ার এসআই-৫৭ পঞ্চম জেনারেশন যুদ্ধবিমান কেনা নিয়ে প্রকাশ্যে কিছু বলেনি। তবে চলমান প্রতিরক্ষা প্রকল্পের সময়মতো সরবরাহ ভারত দাবি করে থাকতে পারে।

বিশেষত এস-৪০০ বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার বাকি ইউনিট ভারতে সরবরাহে বিলম্ব হচ্ছে। ইউক্রেইন যুদ্ধের কারণে রুশ প্রতিরক্ষা শিল্পের ওপর চাপ থাকায় এস-৪০০ দ্রুত সরবরাহের প্রতিশ্রুতি দেওয়া রাশিয়ার জন্য কঠিন হতে পারে।

তবে তার মানে এই নয় যে, দুই দেশের মধ্যে জঙ্গিবিমান কিংবা অন্যান্য বড় ধরনের প্রতিরক্ষা চুক্তি নিয়ে অলক্ষ্যে আলোচনা চলছে না। পুতিনের এবারের ভারত সফর মূলত বাণিজ্য নিয়েই ছিল বলে প্রতীয়মান হয়েছে।