তোমার সুরে সুরে সুর মিলাতে

প্রকাশ : 2022-05-08 15:21:49১ |  অনলাইন সংস্করণ

  নিউজ ডেস্ক   

তোমার সুরে সুরে সুর মিলাতে

অশ্র বসু
-----------


নিজের গান সম্পর্কে রবীন্দ্রনারের বিশেষ অহংকার নিল। বলেছিলেন, ‘মানুষের কতকগুলো অহংকারের বিষয় আছে। যেমন আমার গান।’ সংখ্যার দিক থেকে গানের সঙ্গে কবিতা বা ছবি পাল্লা দিতে পারে। কিন্তু ছবি সম্পর্কে তিনি বলেছিলেন ‘ছবি কিন্তু আমার অহংকারের ডিগ্রিতে পৌঁছেনি।‘ আসলে গানের মধ্যে দিয়ে রবীন্দ্রনাথ বলতে চেয়েছেন, তা এইরকম : আমি আপনার একটা অবজেক্টিভ – মনস্তত্ত্বের একটা দৃশ্য পাই। কি রকম  হৃদয়ে ভেসে উঠছে- কতখানি সত্য, সুখ, দুঃখ আইডিয়ালাই। যেখানে সকল বিশ্বের হার্মনির মূল- আমার গানে সেখানে পৌছই।’

২৬ মে ১৯৪১ সালে রানী চন্দকে আলাপোরিতায় বলা কথাগুলির মধ্যে একটা প্রত্যয় আছে। এই সূত্রেই তিনি বলবেন যে বাঙালিকে তাঁর গান গাইতেই হবে। তিনি জানতেন বাংলাদেশকে দিয়ে তাঁর গান গাওয়াবেন। গানের সব রকম জোগান তিনি দিয়ে গেছেন বলেও জানাচ্ছেন। রবীন্দ্রনারের এই দাবি আজ আশি বছর পরেও এরকম আছে। আজও বাঙালিকে তাঁর গান গাইতেই হচ্ছে। তাঁর গান বিনে সত্যি আজও বাঙালির গীত নেই, এমন নয়। কিন্তু এটা তো ঠিকই যে তিনিই এখনো বাংলা গানে অবিসংবাদী সম্রাট।

গান নিয়ে তাঁর অনেক কথা আছে। অনেক দাবি আছে। সে সব কথা থাক। সেদিনের বলা একটি বাক্যকে আজ আমরা আশ্রয় করি: যেখানে সকল বিশ্বের হার্মনির মূল- আমার গানে সেখানে পৌঁছই।’ বিশ্ব হার্মনি শব্দটি ভারি আশ্চর্য। এই জগৎসংসারটা যে একটা অসামান্য সংগীত, তা রবীন্দ্রনাথ বুঝেছিলেন। বুঝেছিলেন বলেই বারে বারেই তাঁর গানে যে ঈশ্বরকে তিনি আগাগোড়া ‘তুমি’ সম্ভাষরে চিহ্নিত করেন, তাঁর সঙ্গে সুর মেলানোর প্রসঙ্গ।

লক্ষ করব, বিশ্বদেবতা শু্ুধু নয়, জীবনদেবতার প্রসঙ্গে এসেছে এই সংগীতের কথা ‘যে সুরে বাঁধিলে এ বীনার তার/ নামিয়া নামিয়া গেছে বার বার/ হে কবি তোমার রচিত রাগিণী/ আমি কি গাহিতে পারি!’ জীবনদেবতার কাজ আমার জীবনটুকুকে আশ্রয় করেই। সেখানেও চলে তাঁর সঙ্গে সুর মেলানোর প্রয়াস। হয়তো ব্যর্থ প্রয়াস- তবু চেষ্টাটা নিরন্তর। আর যিনি বিশ্বদেবতা, তাঁর সঙ্গে?

১৯৩৩ সালে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন: ”আমার বুদ্ধি মানববুদ্ধি, আমার হৃদয় মানবহৃদয়, আমার কল্পনা মানব্ল্পনা। তাকে যতই মার্জনা করি, শোধন করি, তা মানবচিত্ত কখনোই ছাড়াতে পারে না।... এই বুদ্ধিতে এই আনন্দে যাঁকে উপলব্ধি করি তিনি ভূমা, কিন্তু মানবিক ভূমা।” ঈশ্বরের ধারণাটা এ পর্বে এসে যে আর আগের মতো নেই, তা বলবার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু বিশ্ব হার্মনির বোধটা অপরিবর্তিতই থাকে। সারাজীবন ধরে গানে তিনি এই কথাটি বলবার চেষ্টা করেছেন।

যে গানটির কথা প্রথমেই মনে পড়ে, সেটি হল: যে ধ্রুবপদ দিয়েছ বাঁধি বিশ্বতানে মিলাব তাই জীবনগানে॥ গানটিতে গগনের বিমল নীলের শান্তিময়ী গভীর বাণী, নিশিথকূলে উষার গীতভাষা বা ফুলের সহজ সুরের সঙ্গে জীবনের প্রতি পর্বকে মিলিয়ে নেবার আকাঙ্ক্ষা লক্ষ করি। হৃদয়ে, নীরব প্রাণে, নবীন আশায়, প্রভাতে-সন্ধ্যায় সর্বত্র সেই ধ্রুবপদকে জীবনগানে মেলানো আর্তি ধরা থাকে।

একই ভাবে মনে পড়বে নিশ্চয়: আমার বেলা যে  যায় সাঁঝবেলাতে তোমার সুরে সুরে সুর মেলাতে। আগের গানটিতে যতটা নিশ্চিতভাবে, যতটা অনায়াসে বিশ্বতানের ধ্রুবপদ জীবনগানে ‘মিলাব’ বলতে পেরেছিলেন, এগানে ততটা সহজ থাকছে না আর। তোমার সুরে সুরে সুর মিলানো তো সহজ কথা নয়।  কারণ সে তো হার্মনি। আর আমার তো অবলম্বন একটি তারের একতারা। তাতে আর গানের বেদন কতটা বহন করা যায়! ফলে তোমার সাথে এই খেলাতে বারে বারে অনিবার্য পরাজয়। আসলে এ তার তো কাছের সুরে বাঁধা। কিন্তু তোমার বাঁশি যে বাজে দূরে! তারপরেই রবীন্দ্রনাথ বলছেন গানের লীলার সেই কিনারে বিশ্বহৃদয়পারাবারে রাগরাগিণীর জাল ফেলার খেলায় সবাই যোগ দিতে পারে না। ঠিক এই কথার পরেই আবার যদি মনে করি রবীন্দ্রনাথের কথা : যেখানে সকল বিশ্বের হার্মনির মূল- আমার গানে সেখানে পৌছই’– তখন বুঝতে পারব রবীন্দ্রনাথের অহংকার ঠিক কোথা থেকে আসে। তিনি তাঁর সারা জীবন ধরে এটা বুছেছেন যে তাঁর গানে বিশ্বহার্মনির মূলে তিনি পৌঁছেছেন।

এই বিশ্বহার্মনির সুরে পৌঁছতে চাওয়াটাই রবীন্দ্রনাথের একেবারে অনন্য। নিশ্চয় সেটা একটা আনন্দঘন অভিজ্ঞতা। কিন্তু এর পিছনে যে প্রচণ্ড দুঃখের অনুভব, যে ব্যথা – এবং সে-ব্যথাও শুধু রবীন্দ্রনাথের নয়, তাঁর ঈশ্বরেরও– সে কথাও রবীন্দ্রনাথ উপলব্ধি করেন: যখন তুমি বাঁছনিলে তার সে যে বিষম ব্যথা—বাজাও বীণা, ভুলাও ভুলাও সকল দুখের কথা - এ গানের শেষে যে কথাটি বলেন তা ভারি আশ্চর্য!

বাঁধলে যে সুর তারায় তারায় অন্তবিহীন অগ্নিধারায়, সেই সুরে মোর বাজাও প্রাণে তোমার ব্যাকুলতা॥ তারায় তারায় অন্তবিহীন অগ্নিধারায় যে সুর তিনি বেঁধেছেন, সেই সুরই রবীন্দ্রনাথের প্রাণেও বাজবে – এ আকাঙ্ক্ষাই প্রকাশ  পেয়েছে। এবং তোমার ব্যাকুলতার কথা বলেছেন যেমন, তেমন রবীন্দ্রনারের ব্যাকুলতার কথা বলেছেন যেমন,  তেমন রবীন্দ্রনাথের ব্যাকুলতাও কি কম! ‘আর বিলম্ব কোরো না গো’- এ কথা  উচ্চারণের মধ্যে দিয়েই রবীন্দ্রনাথের তীব্রব্যাকুলতাও প্রকাশ পায়। বিষম  ব্যথার কথা  এসেছে এই গানে। কিন্তু সেই সুর যখন নিজের প্রাণে বাজে, তখনই তো সকল দুখের কথা  ভোলবার আনন্দও তৈরি হয়। আরেকটি গান মনে পড়ে এই সূত্রে: বজ্রে তোমার বাজে বাঁশি, সেকি সহজ গান!

সেই সুরেতে জাগব আমি, দাও মোরে সেই কসন॥ ‘কান’ শব্দটি লক্ষ করতে  হবে। সুরের সাধনা তখনই সম্পূর্ণ যখন সেই সুরটা সম্পূর্ণ করে শুনতে পাব। আমাদের ওস্তাদরা তো বলেন কান তৈরি হওয়ার কথা। বিশ্ব হার্মনিটা সব সময়ে শোনবার মতো তন্ময়তা থাকে, এমনকী রবীন্দ্রনাথেরও? তিনি কি বলেন না, ”তোমার বীণা আমার মনোমাঝে/ কখনো শুনি, কখনো ভুলি, কখনো শুনি না যে।” আনন্দের মুহূর্তে সুরটা চিনে নেওয়া হয়তো সহজ, কিন্তু বজ্রে বাঁশি শোনা তো সহজ নয়। এই সুরে যোগ  দিতে কি সবাই পারে? রবীন্দ্রনাথ চেয়েছেন সেই কঠিনকে। বলেছেন: আমি ভুলব না আর সহজেতে। বিশ্ব হার্মনি তো সহজ বস্তু নয় মোটেই! সে প্রচণ্ড ঝড়ের তাণ্ডব সহ্য করাও কঠিন।

কিন্তু যে ঝড়ের ঝংকারে সপ্তসিন্ধু দশদিগন্ত তিনি নাচান, সেই ঝড় যদি আনন্দে সইতে পারি তবেই তো আরামের আশ্রয় ছিন্ন করে গভীরতর আশ্রয়ে পৌঁছনো যায় –যেখানে অশান্তির অন্তরে সুমহান শান্তি বিরাজ করে! জীবনে সব সময় সেই শান্তি মেলে না। মেলে না, কারণ সব সময় সুরে সুর মেলে না। একটি গানে বলছেন: ছন্দ তোমার ভেঙে গিয়ে দ্বন্দ্ব বাধায় প্রাণে, অন্তরে আর বাহিরে তাই তান মেলে না তানে। সুরহারা প্রাণ বিষম বাধা— সেই তো আঁধি, সেই তো ধাঁ ধাঁ—জগৎসংসারে আনন্দই বলি, সুন্দরই বলি – সবই তো এ্ বৃহৎ chaos-এর ফল। সেখানে আরাম আর শান্তি খুব সহজে মেলে না। এই শান্তি অশান্তির অন্তরেই বাস করে। বসুন্ধরার পঞ্জরতলে শঙ্কার যে কম্পন জাগে, তারও মূলে আছে পিনাকের টঙ্কার। অশান্তিন আঘাত করে বলেই তো বীণা বাজে। কিন্তু তাও শেষ পর্যন্ত কোথাও এ্টা সামঞ্জস্য থাকেই, সেটা না থাকলে অশান্তির অন্তরে শান্তি সুমহান অসম্ভব। সেই সামঞ্জস্য ভ্রষ্ট হলে যে আঁধি, তার সঙ্গে আনন্দে যে ঝড়কে সহ্য  করার কথা আছে, দুটোকে মিলিয়ে ফেললে হবে না!

রবীন্দ্রনাথের গানে এই ভাবটি পুনরাবৃত্ত। ঈশ্বরের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কে সংগীতের কথা বার বার আসে। তার একটা কারণ নিশ্চয় এই যে গানে সেই হার্মনি ধরতে পারেন রবীন্দ্রনাথ সহজে। বলতে পারেন বিশ্বকবির চিত্তমাঝে ভুবনবীণা যেথায় বাজে জীবন তোমার সুরের ধারায় পড়ুক সেথায় লুটে। এমন কথা রবীন্দ্রনাথ বলতে পেরেছিলেন বলেই গান নিয়ে তাঁর অহংকারটা অমূলক নয়।সেটা তাঁকেই সাজে। সৌজন্য- আজকাল।