"তৈলচালিত দ্বিচক্রযানে ৪০১ কিঃমিঃ"
প্রকাশ : 2024-03-10 16:00:30১ | অনলাইন সংস্করণ
নিউজ ডেস্ক
ভ্রমণে অনাগ্রহী ব্যক্তি খুঁজিয়া পাওয়া মুশকিল। আবার যদি তা হয় অনেকদিন পর, তাহলে আর কি! জনাকয়েক বন্ধু মিলে ঠিক করিলাম বর্ষার রূপ দেখিতে যাইব পাহাড় আর ঝর্ণা সমেত। যেই কথা সেই কাজ। দিনক্ষণ হিসাব করিয়া আমরা ৬জন মিলিয়া মোটরচালিত দ্বিচক্রযানে যাওয়ার পরিকল্পনা করিলাম। বন্ধুবর্গের মধ্য হইতে জনাদুয়েক কুচক্র করিতে লাগিল, তাহাদের কথা, আরো কিছুদিন পর যাইলে তাহাদের সুবিধা হইবে। তাহাদের কথায় কর্ণপাত না করিয়া, অনিশ্চিত ভবিষ্যতের আশায় না থাকিয়া আমরা আমাদের সিদ্ধান্তে অটল রইলাম। নির্দিষ্ট দিনে সবাই হাজির হইলাম, কিন্তু ৬জনের ১জন বাকিয়া বসিল, তিনি আবার দিচক্রযানের মালিক, যাহার ফলে আমাদের অন্য আরেকজনের যাত্রা অনিশ্চিত হইয়া পড়িল।তাহার মধ্যে আবার সেই কুচক্রী মহল যাত্রা বাতিল করিবার বিভিন্ন অপচেষ্টা চালাইতে লাগিল নিভৃতে। সকল কুচক্রীদের আশাহত করিয়া পরম করুণাময় সৃষ্টিকর্তার নাম জপিয়া আমরা ৪জন মিলিয়া ১৯/০৮/২০২১ রাত ১১.৩০টায় যাত্রা শুরু করিলাম চট্টলার উদ্দেশ্যে।
বন্ধুদিগের একজন মুঠোফোন ব্যবসায়ী, তিনি তৈল সমৃদ্ধ সুস্বাস্থ্যের অধিকারী, একজন আন্তর্জাতিক মানের হিসাবরক্ষক, অন্যজন বিশিষ্ট মধ্য ব্যবসায়ী ও মানব রপ্তানি প্রক্রিয়ার সহিত জড়িত সর্বগুণের অধিকারী। যাত্রা শুরুর ঘন্টাখানেক পর দাউদকান্দি পার হইয়া রাতের খাবারের জন্য থামিলাম। বিশালাকৃতির তৈলবিহীন পরোটা, মোরগের সহধর্মিণীর ভাজা ডিম্ব ও ডাল-সবজি দিয়া আহার শেষ করিয়া আবার যাত্রা করিলাম। কিছুক্ষণ পর আকাশ ভাঙিয়া গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি শুরু হইল। পথিমধ্যে আমাদিগের জন্য আবার একজন সাদা মনের ভাই তুষার বহুদিন পর আমাদিগকে দেখিতে পাইবেন বলিয়া বৃষ্টির মধ্যে রাস্তায় অপেক্ষমাণ ছিলেন যিনি চৌদ্দগ্রাম থানায় কর্মরত আছেন সাব-ইনস্পেক্টর হিসেবে। তাহার কাছে পৌছালাম বৃষ্টিতে ভিজিয়াই। তাহাকে দেখিয়াই খুশিতে আত্মহারা হইবার উপক্রম হইল সকলের। তাহার সাথে আরো দুইজন ভাই উপস্থিত, জাকারিয়া ও প্রতুল দা। অল্প কিছুক্ষণ পরই বুঝিতে পারিলাম তাহারাও সাদা মনের অধিকারী। আমরা তখন ভিজিয়া চুপসাইয়া আছি। অবস্থা দেখিয়া তাহারা বলিলেন, আপনারা এই নিশিরাতে আর না ভিজিয়া রাতটুকু এইখানে বিশ্রাম লইয়া প্রাতরাশ সারিয়া গন্তব্যে রওনা হইবেন। এই বলিয়া তাহাদের মোটরজান সহিত আমরা রওনা করিলাম ''ভিটা ওয়ার্ল্ড" নামক বাংলোবাড়ির উদ্দেশ্যে। কৃতজ্ঞতা জানাইতে গেলে কোন কিছু দিয়েই পারিব না, আমাদের সে সামর্থ্য নাই। যতদিন বাঁচিয়া থাকিবেন, লোকের চোখের মণি হইয়া রহিবেন এই কামনা রহিল আপনাদিগের জন্য প্রতুল দা। প্রাতরাশ সারিয়া তুষারকে বিদায় জানাইয়া আবার যাত্রা শুরু করিলাম। মিরসরাইয়ে পৌঁছাইয়া দিচক্রযান দুখানা মাহিন নামক এক শুদ্ধ বালকের (যাহার একখানা ক্যাফে রহিয়াছে) হাতে গচ্ছিত রাখিয়া আমরা রওনা করিলাম নাপিত্তাছড়ার উদ্দেশ্যে।
শুরু হইল ভয়ংকর যাত্রা পথ। ঘন্টাখানেক হাটিয়া যাইবার পর পাহাড়ের শুরুতেই দেখা হইল "কুপিকাটাকুম" ঝর্ণার সহিত। ঝাপাইয়া পড়িলাম তাহার তলদেশের জমা শীতল স্বচ্ছ জলের ভিতর। গা শীতল করিয়া পাহাড়ে উঠিব, পথিমধ্যে মুঠোফোন ব্যবসায়ী বাকিয়া বসিলেন। তিনি আর যাইতে রাজি নন। আসার সময়কার সমতল ভূমি আর খরস্রোতা ট্রেইলের রুপ দেখিয়াই তিনি খাড়া পাহাড়ের রুপ এই বর্ষায় কি হইতে পারে তাহা অনুৃমান করিয়া ফেলিলেন। তাহাকে পাহাড়ের তলদেশে রাখিয়াই আমরা যাত্রা শুরু করিলাম। সে কি ভয়ংকর অবস্থা, শুরুতেই পা পিছলাইয়া ধপ করিয়া পড়িলাম, দম বাহির হইবার উপক্রম হইতে লাগিল। কিছুক্ষণ পর বাকি দুই বন্ধু বলিল যাইবার দরকার নাই, পাহাড়ি রাস্তা বৃষ্টি আর অন্যান্য অভিযাত্রীদের ভেজা শরীরের জলে ভয়ংকর রুপ ধারণ করিয়া আছে। কোন রকমে পা পিছলাইয়া পড়িলে বাঁচিবার সম্ভাবণা ক্ষীণ। মনে সাহস জোগাইল দীর্ঘ কেশে অধিকারিণী জনাকয়েক অভিযাত্রী পাহাড়ের চূড়া নামিতে আসিতে দেখিয়া। আবার শুরু করিলাম, সঙ্গী হইল হাতের বড় লাঠিখানা আর সৃষ্টিকর্তা। উপরে উঠিয়া দেখা হইল ভাই "মিঠাছড়ি" এর সাথে, অসাধারণ রুপ! অল্পক্ষণ দাড়াইয়া আবার উঠিতে শুরু করিলাম খরস্রোতা জল আর বিশাল বিশাল সব পাথরের বহরের মধ্য দিয়া। হঠাৎই খেয়াল হইল বা হাতের আঙুল বহিয়া লাল রঙ বাহির হইতেসে, কোথায়, কি উপায়ে এমন হইল বুঝিতে পারিলাম না! যাইতে হইবে অনেকদূর, ঝর্ণার জলে হাতখানা ধুইয়া আবার উঠিতে শুরু করিলাম। যাহারা নামিয়া আসিতেছিল তাহাদিগকে জিজ্ঞেস করিলেই উত্তর আর সময় লাগিবে না, ১০/১৫ মিনিটের মধ্যেই দেখা পাইয়া যাইবেন। কিন্তু কতবার যে এই ১০/১৫ মিনিট শেষ হইল, পথ আর শেষ হয় না। বুঝিলাম, আমরা উপরে উঠিতেছি আর তাহারা নামিতেছে, তাই সময়ের হিসাব মিলিতেছে না! নাপিত্তাছড়ার ট্রেইলকে হাতের ডানে রাখিয়া আমরা বা পাশের ট্রেইল ধরে উঠিতে শুরু করিলাম। ক্ষণসময় পার করিয়াই দেখা হইল তাহার সাথে! আহা!! কি সৌন্দর্য!! কি মনোমুগ্ধকর!! কি বিশাল তাহার আকৃতি!! অনিন্দ্য সুন্দর "বান্দুরাখুম"। শুরু হইয়া গেল স্থিরচিত্র লইবার। এরই ফাঁকে হিসাবরক্ষক বন্ধুটি ঝর্ণার জলে মূত্র বিসর্জন করিয়া মৃদু হাসিয়া উঠিল। বেশ কিছুক্ষণ " বান্দুরাখুম" এর সৌন্দর্য অবলোকন করিয়া আবার যাত্রা করিলাম। গন্তব্য এইবার "নাপিত্তাছড়া "। সেখানে যাইয়া আনন্দে আত্মহারা হইবার মতো অবস্থা আমাদিগের। পাহাড়ের বুকে যে এত অভিমান লুকাইয়া থাকে তাহা এই ঝর্ণার রুপ না দেখিলে বুঝিতে পারিতাম না। মনের শান্তি মিটাইয়া " নাপিত্তাছড়া" কে দেখিলাম, সৃষ্টিকর্তার প্রতি শুকরিয়া আদায় করিলাম, ঝর্ণার নীচে বসিয়া থাকিলাম, স্থিরচিত্র তুলিলাম। এইবার হইবে খেলা, সবচেয়ে কঠিনতম অংশ। নামিতে হইবে। কলিজা শুকাইয়া গেল। আবার সন্ধ্যা নামিয়া আসিতেছিল। দেরি করিলেই বিপদ। সৃষ্টিকর্তার নাম জপিতে জপিতে নামিতে শুরু করিলাম। নামিতেছি আর গা কাঁপিতেছে। মিঠাছড়ির আগে আসিয়া পাহাড়ের তলদেশের দিকে তাকাইয়া গা হিম হইয়া আসিল। পিচ্ছিল খাড়া পথ। হঠাৎ মনে হইল মুঠোফোন ব্যবসায়ীকে কুপিকাটাকুম এর নীচে রাখিয়া আসিয়াছি, তাহাকে দেখিলাম, আহা! বেচারা! তাহার মুঠোফোন খানাও আমাদের নিকট,তাহার হাতেও কোন টাকা নাই, অসহায় ভঙ্গিতে আমাদের দিকে তাকাইয়া হাত নাড়াইয়া দ্রুত নামিতে বলিলেন। আমরা লেবুর শরবত, চিপস গলাধঃকরণ করিয়া নামা শুরু করিলাম। পথিমধ্যে একজনকে দেখিলাম, যাহার হাত-পা এর সহিত তাহার হাতে ধরার লাঠিখানাও কাঁপিতেছে। তখন নিজেকে সাহসী মনে হইল। ধীরে ধীরে মাটি কামড়াইয়া সবার আগে নামিয়া আসিলাম। বাকিদের বলিলাম আমি যে পথে আসিয়াছি সেই পথটা ঘাস সম্বলিত, হাত কিছুটা নিরাপদ। মধ্য ব্যবসায়ী বন্ধু নিজের বুদ্ধির উপর ভরসা করিয়া অন্যপথ দিয়া আসিতেই হইল কান্ডখানা, ধপ করিয়া পড়িলেন। বাকিটা পথ তাহাকে কোমড় ব্যথা লইয়াই আসিতে হইয়াছে। নীচে নামিয়া আর কালক্ষেপণ না করিয়া আমরা চলিয়া আসিলাম মাহিনের ক্যাফেতে, স্নান করিয়া তাহার ক্যাফেতে মধ্যাহ্ন ভোজ সারিয়া ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হইলাম। পথিমধ্যে আবার অপেক্ষমাণ ছিল আমার প্রিয় ভাই তুষার! তাহার সহিত দেখা করিয়া, বিখ্যাত রসমালাই গলাধঃকরণ করিয়া ক্ষণকাল বিশ্রাম লইলাম। দেখা হইবার সাথে সাথেই আলিঙ্গন করিব পণ করেছিলাম, জলে চুপসে থাকিবার কারণে যাইবার সময় না পারিবার জন্য আসার সময় আর সে সুযোগ ছাড়িলাম না! রাত ১২.৪৫ মিনিটে ঘরে ঢুকিয়া স্নান করিয়াই গা এলাইয়া দিলাম। সকালে উঠিয়াই আমার মনে পড়িল ব্যায়ামাগারে যাইবার দ্বিতীয় দিবসের স্মৃতি!
লেখক- মহসিন হোসাইন কিশোর