তিতুমীর কলেজঃ আমার অবহেলার বিদ্যাপীঠ

প্রকাশ : 2021-09-11 11:37:52১ |  অনলাইন সংস্করণ

  নিউজ ডেস্ক   

তিতুমীর কলেজঃ আমার অবহেলার বিদ্যাপীঠ

ঝর্না রহমান
------------

আমার প্রথম সন্তান জন্মগ্রহণ করলো তিতুমীর কলেজে পড়াকালীন, ১৯৭৫-এর এপ্রিলে। কাজেই ফেব্রুয়ারির পরেই আমার ‘অ্যাডভান্স স্টেজ’ শুরু হলো। নিজেকে মনে হতে লাগলো পাথরবাহী পিরামিড-শ্রমিক। এত ওজন দেহের! নিজের দিকে তাকাতে পারি না। আমার ফড়িংয়ের মতো ফুরফুরে শরীরটি কী করে এমন বেঢপ হয়ে গেল! কী যে অদ্ভুত দেখাচ্ছে আমাকে! এ অবস্থায় আমি কলেজে যাবো কী করে?

আমি কলেজে যেতাম রিকশা করে। গুলশান পোস্ট অফিস কোয়ার্টারে আমাদের বাসা। মানে আমার আব্বার বাসা। এখনকার মতো সে-সময় এমন অলিতে গলিতে রিকশা পাওয়া যেতো না! বাসা থেকে বেরিয়ে টিএন্ডটি অফিস পেরিয়ে মেইন রোডে এলে রিকশা পাওয়া যেতো। সেই রিকশা তিতুমীর কলেজের মেইন গেটে থামতো। গেটে নেমে কলেজ প্রাঙ্গণের লম্বা রাস্তা হেঁটে পেরিয়ে আমাদের ক্লাসের বিল্ডিংয়ে ঢুকতে হতো। কিন্তু সে সময়টাতে এই রাস্তাটুকু হেঁটে যেতে আমি যেন মরমে মরে যেতে লাগলাম। হাঁটতেও কষ্ট হতে লাগলো। আমার স্বামী আমার কষ্টটা বুঝতে পেরে বললেন, একটা নিজেদের বাহন হলে ভালো হত। তাহলে তোমাকে কলেজের ভেতরে সিঁড়ির সামনে নামিয়ে দিয়ে আসতে পারতো। তো ‘নিজেদের বাহন’ মানে কী, আমরা তো আর নিজেদের গাড়ির কথা ভাবতে পারি না! এমন কি নিজেদের একটা রিকশার কথাও ভাবতে পারি না। আমার পিতা আর ত্রাতা দুজনই নিতান্ত মাস-মাইনে সরকারি চাকরিজীবী। তা ছাড়া চুয়াত্তর-পঁচাত্তরের সে সময়টায় চলছিলো স্বাধীনতা-পরবর্তী নানান সংকট। এর মধ্যে ছিল দুর্ভিক্ষ। চালের বাজারে আগুন। অন্যান্য জিনিসপত্রের দামও ঊর্ধ্বমুখী। চাকরির বেতনের গোনাগুনতি টাকা দিয়ে সংসার চালানোই কঠিন! তাই ঠোঁট উল্টে বলি, দূর কী যে বল, নিজেদের বাহন হবে কীভাবে? স্বামী বললেন, হবে। তো হল! একটা রিকশা মাসকাবারি ভাড়া নেয়া হল! রিকশাওয়ালা প্রতিদিন কলেজ টাইমে আমাকে বাসা থেকে তুলে নিয়ে একেবারে কলেজের ভেতরে ঢুকে সিঁড়ির সামনে নামিয়ে দেবে আবার ছুটির পরে সিঁড়ির সামনে থেকে তুলে নিয়ে আসবে বাসায়! ব্যবস্থা জেনে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। যাক, ঢাউস পেট নিয়ে আমাকে আর হেলেদেুলে অদ্ভুত ভঙ্গিতে হেঁটে হেঁটে গেট থেকে কলেজের ভেতরে ঢুকতে হবে না। সে-সময় রিকশা ভাড়া ছিল কম। বাসা থেকে কলেজের ভাড়া ছিল দু টাকা আড়াই টাকা। আমার জন্য মাসকাবারি ভাড়া সম্ভবত দেড়শো কি দুশো টাকায় করা হল। এখন পুরোপুরি মনে নেই।

রিকশাচালক একজন তরুণ। বিশ বাইশ বছর বয়স। ছেলেটির নামও ভুলে গেছি। কিংবা নাম জানাই হয়নি! প্রতিদিন ও রিকশা নিয়ে এসে বাসার সামনে দাঁড়িয়ে ক্রিং ক্রিং করে বেল বাজাতো। আমি বইখাতা নিয়ে পেট সামলাতে সামলাতে কষ্টে রিকশায় উঠে বসতাম, আর ও সাবাধানে চালিয়ে নিয়ে যেতো। আব্বা ছেলেটিকে খুব করে বলে দিয়েছিলেন যেন রিকশাতে কোনো ঝাঁকুনি না লাগে। ভরা পেট নিয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে রিকশার দরদাম করা আর কলেজ গেট থেকে হেঁটে সিঁড়ি পর্যন্ত যাওয়ার সময়ে যে লজ্জা আর সংেকোচ আমাকে ঘিরে ধরতো তা থেকে পরিত্রাণ পাওয়াতে রিকশাচালক ছেলেটিকে আমার মনে হতে লাগলো দেবদূত। মনে মনে ওকে ধন্যবাদ জানাতাম। ওর প্রতি কৃতজ্ঞতায় মন ভরে উঠতো আমার।

এভাবে পনের কি বিশদিন মাসকাবারি রিকশায় চেপে আমি যাতায়াত করি। হঠাৎ একদিন রিকশা নিয়ে চালক ছেলেটি আর এলো না। ভাবলাম, হয় তো কোনো ঝামেলা হয়েছে। কিন্তু তার পরদিনও এলো না। এবং তার পরদিনও না। এভাবে তিন চারদিন পেরিয়ে যাওয়ার পর আমরা ভাবলাম হয়তো ছেলেটির কোনো অসুখ করেছে। আম্মা চিন্তিত মুখে বললেন, কোনো অ্যাকসিডেন্ট করলো না তো? সে সময় তাৎক্ষণিক যোগাযোগের কোনো সহজ উপায় ছিল না। ছেলেটির কোনো ঠিকানাও জানা হয়নি। আমার স্বামী চেষ্টা করলেন রিকশা স্ট্যান্ডে গিয়ে খবর নিতে। কিন্তু কারো কাছেই কোনো খবর পাওয়া গেল না। যাই হোক, আমরা ভাবলাম অসুখ বিসুখ করলেও শরীর ভালো হয়ে গেলে ও নিশ্চয়ই ওর পাওনা টাকাটা নিতে আসবে। কারণ প্রায় পুরো মাসই ও কাজ করেছে। আর তিন চারদিন পরেই ওর পাওনা মিটিয়ে দেবার ডেট ছিলো। কিন্তু চালক ছেলেটি আর এলো না। আব্বাও নানাভাবে ওর খবর জানার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু কোনো খবরই জানা গেল না। ছেলেটি যেন হারিয়েই গেল। রিকশাচালক ছেলেটির বেখবর হওয়ার কারণে আমার কলেজ যাতায়াত আবার আগের মত প্রতিকূল হয়ে পড়লো। সন্তান জন্মের আগ পর্যন্ত আমি মাঝে মাঝে কলেজে যাওয়া বাদ দিতে লাগলাম। আর প্রতিদিন আমাদের বাসার টেরাসে দাঁড়িয়ে রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকতাম, যদি পরিচিত সেই ছেলেটি রিকশা চালিয়ে হঠাৎ চলে আসে! যদি হঠাৎ আমার কলেজ যাওয়া বা কলেজ থেকে ফেরার টাইমে পরিচিত কোনো ক্রিং ক্রিং ধ্বনি বেজে ওঠে রাস্তায়!

আমার ছেলে জন্মবার দু মাস পরে, জুন মাসে আমার আব্বা বদলি হয়ে গেলেন। আব্বার অফিস হলো বাসাবোতে। সুতরাং আমরা গুলশান এলাকা ছেড়ে বাসাবো এলাকায় চলে গেলাম। সেখান থেকে আমি তিতুমীর কলেজে আসতাম বাসে চড়ে। ছয় নম্বর বাস। মতিঝিল পীরজঙ্গী মাজার থেকে ছাড়তো। ওটাই ছিল স্টার্টিং পয়েন্ট। বাসাবো থেকে রিকশায় মতিঝিল এসে পীরজঙ্গি মাজার থেকে খালি বাসে চড়ে বসতাম। বাস ভরলে ছেড়ে দিতো। কিন্তু কলেজ ছুটির পর আর সহজে বাসে উঠতে পারতাম না। কলেজ থেকে বের হয়ে কাছেই বাস স্ট্যান্ড ওয়ারলেস গেইট। একের পর এক ছয় নম্বর বাস আসতো। কিন্তু তিনটা চারটা পাঁচটা বাস চলে গেলেও উঠতে পারতাম না। কারণ এক-একটা বাস আসা মাত্র ছেলেরাই হৈ হৈ করে লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে বাসে উঠে যেত। সিট যেত ভরে। বাস ছেড়ে দিত। ওদের সাথে ঠেলাঠেলি করে বাসে ওঠার কথা চিন্তাও করতাম না। চুপচাপ দূরে দাঁড়িয়ে থাকতাম। ছেলেদের ভিড় কমে গেলে আমি এক নাদান তরুণী বাসে ওঠার অবকাশ পেতাম। তবে পুরো সময়টায় আমার চোখ খুঁজতো সেই রিকশাচালক ছেলেটিকে। হালকাপাতলা দেহ। বছর বিশেকের এক তরুণ। যে আমার প্রথম মাতৃত্বের কষ্টকর সংকোচপ্রবণ কুণ্ঠিত দিনগুলোতে তিতুমীর কলেজে যাতায়াতের সময়টিকে নির্ভার আর নিঃসংকোচ করে তুলেছিলো। জীবনের এতগুলো বছর পেরিয়ে এসেও চালক ছেলেটির কথা আমি বিস্মৃত হতে পারিনি। মাঝে মাঝেই মনে পড়ে ওর কথা। যেখানেই থাকুক, ভালো থাকুক আমার দুঃখদিনের দরদী। তাঁর প্রতি রইলো আমার গভীর শ্রদ্ধা।

(চলবে)

ঝর্না রহমান