ড. জামিলুর রেজা চৌধুরীর প্রয়াণ ও পদ্মা সেতু প্রকল্প নিয়ে কিছু কথা

প্রকাশ : 2022-06-21 12:13:40১ |  অনলাইন সংস্করণ

  নিউজ ডেস্ক   

ড. জামিলুর রেজা চৌধুরীর প্রয়াণ ও পদ্মা সেতু প্রকল্প নিয়ে কিছু কথা

জাতীয় অধ্যাপক ড. জামিলুর রেজা চৌধুরী, যিনি সবার কাছে জেআরসি নামে পরিচিত, কাউকে কিছু বুঝতে না দিয়ে গত ২৮ এপ্রিল প্রত্যুষে ঘুমের মধ্যে চলে গেলেন। রোজা রাখার জন্য সাহির খেতে উঠে তার স্ত্রী স্বামীর গায়ে হাত দিয়ে বুঝতে পারেন কোনো একটা সমস্যা হয়েছে। তিনি পাশের ফ্ল্যাটের বাসিন্দাদের ডেকে বিষয়টি জানান। ধানমন্ডি ৯ নম্বর সড়কের ৬ নম্বর বাড়ির যে ফ্ল্যাটটিতে অধ্যাপক জেআরসি থাকতেন, তার পাশের ফ্ল্যাটসহ কয়েকটি ফ্ল্যাটের স্বত্বাধিকারী আমানত শাহ গ্রুপের চেয়ারম্যান হেলাল মিয়া ও তার পরিবারের অন্য সদস্যরা। হেলাল মিয়ার ভাতিজাদের সহায়তায় জেআরসিকে দ্রুত স্কয়ার হাসপাতালে নিয়ে গেলে ডাক্তার তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

বাংলাদেশে নভেল করোনাভাইরাস বা কভিড-১৯-এর সংক্রমণ শুরু হয় মার্চের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে। করোনাকালে জেআরসি মারা যান। সংগত কারণেই অতি নিকটাত্মীয় ছাড়া তার শেষকৃত্যে তার বন্ধু, সহকর্মী ও শুভাকাঙ্ক্ষীদের অনেকেই যোগদান করতে পারেননি। সেদিনই জোহরের নামাজের পর জানাজা শেষে বনানী কবরস্থানে তার মরদেহ দাফন করা হয়। মৃত্যুর সময় তার সন্তানরা বিদেশে অবস্থান করছিলেন। করোনা মহামারীর কারণে তার শেষকৃত্যেও তারা যোগদান করতে পারেননি।

অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরীকে চেনেন না এমন লোক বাংলাদেশে খুব কমই আছে। আমার সঙ্গে তার ব্যক্তিগত পরিচয় ঘটে ২০০৫ সালে। আমি তখন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয় উইংয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন, ১৯৯২ যুগোপযোগী ও কতিপয় ক্ষেত্রে সংশোধন করে সংশোধিত নতুন আইন প্রণয়নের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের চেয়ারম্যান এবং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের কতিপয় ভিসিকে নিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে মন্ত্রীর নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির সভায় কখনো মন্ত্রী, কখনো সচিব সভাপতিত্ব করতেন। আমি ছিলাম সদস্য সচিব। এ কমিটির সদস্যদের মধ্যে ড. জেআরসি, ড. আবদুল মজিদ খান, ড. বজলুল মুবিন চৌধুরী ছিলেন অন্যতম। জেআরসি তখন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি। বলতে গেলে বিশ্ববিদ্যালয়টি তার হাতেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন সংশোধন ছাড়াও ওই সময় শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও ইউজিসির যৌথ উদ্যোগে বেশ কয়েকটি নতুন বিধি ও আইন প্রণয়নের কার্যক্রম চলমান ছিল। এর মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় অ্যাক্রেডিটেশন কাউন্সিল গঠন আইন, সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য অভিন্ন হিসাব বিধিমালা, স্ট্র্যাটেজিক প্ল্যান ফর হায়ার এডুকেশন (২০০৬-২০২৬) অন্যতম। সব কমিটিতেই জেআরসিকে রাখা হতো। শেষোক্ত কমিটির আইসিটি ইন এডুকেশন সাব কমিটির তিনি ছিলেন আহ্বায়ক। আইন ও বিধিমালার ড্রাফটিংয়ে তিনি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতেন। সে সময় কার্যোপলক্ষেই তার সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত পরিচয়ের সূত্রপাত। কাছ থেকে আমি দেখেছি তার মেধা ও মননশীলতা, নিরপেক্ষতা ও দায়িত্বশীলতা। পরবর্তীতে ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারিতে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের সেতু বিভাগের সচিব হিসেবে যোগদানের পর জেআরসিকে পদ্মা সেতু প্রকল্পের আন্তর্জাতিক প্যানেল অব এক্সপার্টসের সভাপতি হিসেবে পেয়েছি। তার সঙ্গে একত্রে কাজ করা এবং বহু অভিজ্ঞতার বর্ণনা দেয়ার আগে জামিলুর রেজা চৌধুরীর সংক্ষিপ্ত পরিচয় পাঠকদের সামনে তুলে ধরছি।

২. জাতীয় অধ্যাপক ড. জামিলুর রেজা চৌধুরীর জন্ম ১৫ নভেম্বর ১৯৪২ সালে, সিলেটে। তার পিতা আবিদ রেজা চৌধুরী ও মাতার নাম হায়াতুন্নেছা। পৈত্রিক নিবাস আসামের কাছাড় জেলায়। চাকরির সুবাদে আবিদ রেজা চৌধুরী পরিবারসহ সিলেটে অবস্থানকালে জামিলুর রেজা চৌধুরীর জন্ম হয়। দেশভাগের পর আবিদ রেজা চৌধুরী পূর্ব পাকিস্তানে চলে আসেন এবং স্থায়ী নিবাস গড়েন ৬৮ এলিফেন্ট রোড, ঢাকায়। তিনি সেইন্ট গ্রেগরিজ হাই স্কুল থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে মেট্রিকুলেশন এবং ঢাকা কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) ভর্তি হন। ১৯৬৩ সালে তিনি পুরকৌশল বিভাগ থেকে বিএসসি ইঞ্জিনিংয়ারিংয়ে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান অধিকার করেন এবং বুয়েটের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বা পুরকৌশল বিভাগে লেকচারার হিসেবে যোগদান করেন। জেআরসি যুক্তরাজ্যের সাউদাম্পটন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএসসি ও পিএইচডি লাভ করেন। পরবর্তীতে তিনি ম্যানচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন। তিনিই ব্রিটিশ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এ ডিগ্রিপ্রাপ্ত প্রথম বাংলাদেশী। ১৯৬৩ থেকে ২০০১ পর্যন্ত বুয়েটের শিক্ষক হিসেবে অধ্যাপক, বিভাগীয় প্রধান ও ডিনের দায়িত্ব পালনকালে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের এবং দেশের বহু গুরুত্বপূর্ণ কাজের সঙ্গে তিনি জড়িত ছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট ও একাডেমিক কাউন্সিল ও বহু নীতিনির্ধারণী কমিটিতে তিনি সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৮ সালে তিনি যখন পুরকৌশল বিভাগের প্রধান, তখন  এ বিভাগের মাত্র ১২ জন শিক্ষকের মধ্যে তিনিই ছিলেন একমাত্র পিএইচডি ডিগ্রিধারী। তিনি এ বিভাগের সম্প্রসারণে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখেন। এখন এ বিভাগে প্রায় ৬০ জন পিএইচডি ডিগ্রিধারী শিক্ষক রয়েছেন।

প্রফেসর জেআরসির উদ্যোগে ১৯৬৮ সালে বুয়েটে প্রথম কম্পিউটার প্রোগ্রামিং কোর্স প্রবর্তন করা হয়। ১৯৭৮-৭৯ সালে বুয়েট কম্পিউটার সেন্টার স্থাপিত হয়। ১৯৮০ থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত তিনি এ সেন্টার পরিচালনার দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৭ সালে সরকার কর্তৃক গঠিত তথ্যপ্রযুক্তিসংক্রান্ত টাস্কফোর্সের তিনি নেতৃত্ব দেন। জেআরসি কমিটির সুপারিশমালা বাস্তবায়নের মাধ্যমে দেশে আইসিটি উন্নয়নের ভিত্তি গড়ে ওঠে। এছাড়া ২০০০, ২০০৪ ও ২০০৮ সালে গঠিত তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি নীতিমালা প্রণয়ন কমিটিগুলোরও তিনি ছিলেন সভাপতি। উঁচু ইমারত ডিজাইনের জন্য তার উদ্ভাবিত Coull and chowdhury method সারা বিশ্বে বহুল ব্যবহূত। মাস্টার প্ল্যান ফর সাইক্লোন সেন্টারস প্রণয়নের তিনি ছিলেন দলনেতা। এছাড়া তিনি স্বাধীনতা স্তম্ভ বাস্তবায়ন কমিটিরও সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। ঢাকায় পরিকল্পিত যোগাযোগ ব্যবস্থা স্থাপনের জন্য বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় একটি স্ট্র্যাটেজিক ট্রান্সপোর্ট প্ল্যান প্রণীত হয় ২০০৫-০৬ সালে। ওই প্ল্যান প্রণয়নের সময় জেআরসি অ্যাডভাইজরি কমিটির সভাপতি ছিলেন। তিনি এমআরটি-৬ তৈরির বিশেষজ্ঞ প্যানেলের সভাপতি, চট্টগ্রামের এমএ হান্নান আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ডিজাইন তদারকি কমিটির সভাপতি এবং দেশের অন্য আরো অবকাঠামো উন্নয়নসংক্রান্ত পরামর্শক বা বিশেষজ্ঞ কমিটির নেতৃত্ব দেন। ঢাকা মেট্রোরেল প্রকল্পেরও তিনি ছিলেন প্রধান উপদেষ্টা। এছাড়া ঢাকা শহর উন্নয়ন ও সংরক্ষণের জন্য রাজউক প্রণীত ডিটেইল এরিয়া প্ল্যান (ড্যাপ) কমিটির তিনি ছিলেন অন্যতম সদস্য।

অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী দেশে-বিদেশে বহু সামাজিক, সাংস্কৃতিক, ক্রীড়া, স্বাস্থ্যসেবা,  শিক্ষা ও জনকল্যাণমূলক সংস্থার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। বাংলাদেশে গণিত অলিম্পিয়াড জনপ্রিয় করার পশ্চাতে ছিলেন জেআরসি। ২০০৩ সাল থেকে আমৃত্যু তিনি অলিম্পিয়াড কমিটির সভাপতি ছিলেন। তার লেখা ৭৫টি গবেষণা প্রবন্ধ দেশী-বিদেশী জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। শিক্ষা, বিজ্ঞান ও ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য তিনি জীবদ্দশায় ২১টি সম্মাননা পদকপ্রাপ্ত হন। দেশে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে অবদানের জন্য ২০১৭ সালে একুশে পদক লাভ করেন। বাংলা একাডেমি, এশিয়াটিক সোসাইটি, বাংলাদেশ একাডেমি অব সায়েন্সেস ও ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটসহ বহু প্রতিষ্ঠানের তিনি ছিলেন আজীবন ফেলো। অধ্যাপক শামসুল হকের নেতৃত্বে গঠিত যে কমিটি ১৯৯৮ সালে জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন করেছে, তার অন্যতম সদস্য ছিলেন প্রফেসর জেআরসি। ১৯৯৬ সালে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনের প্রাক্কালে দেশে বিচারপতি হাবিবুর রহমানের (প্রধান উপদেষ্টা) নেতৃত্বে যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার দায়িত্ব পালন করে, অধ্যাপক জেআরসি ওই সরকারের একজন মাননীয় উপদেষ্টা ছিলেন।

বাংলাদেশের প্রথম বৃহৎ সেতু প্রকল্প যমুনা বহুমুখী সেতু প্রকল্পের আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ প্যানেলের অন্যতম সদস্য ছিলেন প্রফেসর জেআরসি। ওই সেতুর কাজে সরাসরি যুক্ত থাকার সুবাদে পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পের কাজ শুরু হলে তাকে ১১ সদস্যের বিশেষজ্ঞ প্যানেলের সভাপতি নিযুক্ত করা হয়। এ প্যানেল সেতুর ডিজাইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন পর্যায়ে প্রকল্প কর্মকর্তা, ডিজাইন পরামর্শক ও উন্নয়ন সহযোগীদের বিশেষজ্ঞ পরামর্শ প্রদান করে। আমি ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারিতে সেতু বিভাগের সচিব হিসেবে নিযুক্তি পাওয়ার পর জেআরসিকে দেখেছি কীভাবে তিনি দেশী-বিদেশী বিশেষজ্ঞদের নিয়ে কাজ করেছেন এবং কমিটির নেতৃত্ব দিয়েছেন।

পদ্মা সেতুর ভৌত কাজকে মূলত পাঁচটি প্যাকেজে ভাগ করা হয়েছে যথা— মূল সেতু, নদী শাসন, জাজিরা অ্যাপ্রোচ রোড, টোল প্লাজা ইত্যাদি। মাওয়া অ্যাপ্রোচ রোড, টোল প্লাজা ইত্যাদি এবং মাওয়া ও জাজিরা সার্ভিস এরিয়া। প্রকল্পে নিয়োজিত ডিজাইন পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ‘মনসেল-এইকম’ ভৌত কাজের ঠিকাদার নিয়োগের প্রিকোয়ালিফিকেশন বিড ডকুমেন্ট প্রস্তুত, টেন্ডার আহ্বানের পর টেন্ডার ডকুমেন্ট মূল্যায়ন, টেন্ডার কমিটিকে সহায়তাসহ এ-সংক্রান্ত যাবতীয় কাজের দায়িত্বপ্রাপ্ত। আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ প্যানেল ডিজাইন পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের কাজ তদারক করত। আমি সেতু বিভাগের সচিব হিসেবে যোগদানের আগেই ভৌত কাজের বিভিন্ন প্যাকেজের জন্য দরপত্র মূল্যায়ন কমিটি গঠন করা হয়েছিল। পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পের পরিচালক ছিলেন কারিগরি মূল্যায়ন কমিটির সভাপতি। প্রকল্পের ব্যাপকতা ও গুরুত্ব বিবেচনায় এবং বিভিন্ন প্যাকেজের দরপত্রগুলোর স্বচ্ছ ও বস্তুনিষ্ঠ মূল্যায়নের উদ্দেশ্যে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে পরামর্শ ও যোগাযোগমন্ত্রীর অনুমোদনক্রমে আগে গঠিত কমিটি পরিবর্তন করে দেশের কয়েকজন বরেণ্য ও প্রশ্নাতীত সততার অধিকারী বিশেষজ্ঞ পর্যায়ের প্রকৌশলীর সমন্ব্বয়ে কারিগরি মূল্যায়ন কমিটি গঠন করি। কমিটির প্রধান ছিলেন প্রফেসর জামিলুর রেজা চৌধুরী।

পদ্মা সেতুর কনস্ট্রাকশন সুপারভিশন কনসালট্যান্ট নিয়োগের প্রস্তাব মূল্যায়নের জন্য আগে গঠিত কমিটি কয়েকবার পরিবর্তন করতে হয়েছে। সর্বশেষ উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন কমিটির আহ্বায়ক হিসেবে জেআরসিকে নিয়োগ দেয়া হয়। পাঁচ সদস্যের কমিটির আরো দুজন সদস্য ছিলেন বুয়েটের ভিসি ড. সফিউল্লাহ ও ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ড. আইনুন নিশাত।

২০১০-১১ সালে সেতু বিভাগে আমাদের কর্মময় দিনগুলোর কথা মনে পড়ে।  পদ্মা সেতু প্রকল্পের আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ কমিটির সভাগুলোয় আমিও উপস্থিত থেকে কাজের অগ্রগতি পর্যালোচনা করতাম। উদ্ভূত সমস্যা সমাধানের জন্য বিশেষজ্ঞদের সবার মতামত শুনে একটি সমাধানে ঐকমত্য হতো। এসব সভায় লক্ষ করেছি জেআরসির মেধা, প্রজ্ঞা ও অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞানের সমাহার এবং সভা পরিচালনার ক্ষমতা। পদ্মা সেতুর ডিজাইন প্রণয়ন নিয়ে কখনো কখনো প্যানেল অব এক্সপার্টসের পর্যবেক্ষণ থাকত। সে পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী ডিজাইন প্রণয়ন বা সংশোধন করা হতো। প্যানেল বিশেষজ্ঞরা পদ্মাপাড়ের নির্মাণ সাইট পরিদর্শন করেও তাদের রিভিউ মতামত দিতেন। ডিজাইন প্রস্তুত কাজের অগ্রগতি দেখার জন্য আমি প্রফেসর জেআরসিসহ অন্য কয়েকজন বিদেশী বিশেষজ্ঞকে নিয়ে দুবার হংকং গিয়েছি। একবার ডিজাইন পরামর্শক ও চেকিং ইঞ্জিনিয়ারদের মধ্যে উদ্ভূত বিরোধ মীমাংসার জন্য হংকং যেতে হয়েছে। সবাইকে এক টেবিলে বসিয়ে দিয়ে আমি বলেছি, ‘যতদিন লাগে আপনারা হংকংয়ে থাকবেন। সমস্যার সমাধান না করে কেউ হংকং ত্যাগ করতে পারবেন না।’

ওই সময়ে সত্তরের কাছাকাছি বয়সেও জেআরসি ভালো স্বাস্থ্যের অধিকারী ছিলেন। নাশতা বা ডিনারে কেক, মিষ্টিজাতীয় ডেজার্ট খেতেন। একবার ঢাকা-হংকং পাশাপাশি বসে প্লেনে ভ্রমণের সময় ডিনারের পর ‘হজেন ডজ’ চকোলেট ভ্যানিলা আইসক্রিম পরিবেশন করা হয়। আমি আমার আইসক্রিমটি খেতে খেতে জেআরসিকে বললাম, ‘স্যার, আপনি তো আইসক্রিম খাবেন না, তাই না?’ আমার উদ্দেশ্য ছিল, তিনি না খেলে আমি তার আইসক্রিমটিও নেব। জেআরসি বললেন, ‘খাব, আমি এ ব্র্যান্ডের আইসক্রিম পছন্দ করি।’

পদ্মা সেতু প্রকল্প ছাড়াও ওই সময়ে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প সেতু বিভাগে চলমান ছিল। যেমন ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, যমুনা বঙ্গবন্ধু সেতুর ফাটল মেরামত, বঙ্গবন্ধু সেতুর উভয় তীরের অ্যাপ্রোচ রোড মেরামত ইত্যাদি। এসব প্রকল্পের টেন্ডার মূল্যায়ন কমিটির সভাপতিও ছিলেন প্রফেসর জেআরসি। যে চীনা কোম্পানিটি ফাটল মেরামতের কাজ করেছে, তাদের অভিজ্ঞতা পর্যবেক্ষণের জন্য আমি জেআরসিকে চীন পাঠিয়েছিলাম। পদ্মা সেতুর মূল্যায়ন কাজ চলাকালে একবার যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন মূল্যায়ন অগ্রগতি বিষয়ে জানার জন্য কমিটির সদস্যদের সঙ্গে কথা বলতে চাইলেন। প্রথমে জেআরসি মন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে আপত্তি জানালেও আমার অনুরোধে জেআরসি ও ড. আইনুন নিশাত আমার সঙ্গে মন্ত্রীর কক্ষে গেলেন। সৈয়দ আবুল হোসেন জেআরসিকে ‘স্যার’ বলে সম্বোধন করেন এবং কথাবার্তার সময় সুআচরণ করেন। শুধু মূল্যায়ন অগ্রগতির বিষয় ছাড়া মূল্যায়নে ‘প্রভাব বিস্তার’ হতে পারে এমন কিছুই বলেননি। মন্ত্রীর আচরণ ও আতিথেয়তায় উভয়েই সন্তুষ্টচিত্তে মন্ত্রীর কক্ষ থেকে ফিরে এলেন।

বিশ্বব্যাংক ও অন্যান্য উন্নয়ন সহযোগীর সঙ্গে নিবিড় সমন্বয়ের মাধ্যমে পদ্মা সেতুর কাজ দ্রুতগতিতে এগিয়ে নেয়ার জন্য যোগাযোগমন্ত্রীর নেতৃত্বে আমি সর্বোতভাবে চেষ্টা করেছি। কিন্তু দেশের শত্রু একটি কুচক্রী মহল আমাদের বিরুদ্ধে পদ্মা সেতুর সুপারভিশন কনসালট্যান্সির কাজ একটি বিশেষ কোম্পানিকে পাইয়ে দেয়ার ‘দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের’ অভিযোগ উত্থাপন করে। বাংলাদেশের দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ও বিশ্বব্যাংক নিয়োজিত আন্তর্জাতিক আইন বিশেষজ্ঞ প্যানেল বিষয়টি তদন্ত করে। আমাকে প্রধান আসামি করে দেশী-বিদেশী সাতজনের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। বিশ্বব্যাংকের অভিযোগের তীর সৈয়দ আবুল হোসেনের বিরুদ্ধে নিক্ষিপ্ত হলেও তাকে আসামি না করায় দুদক ও সরকারের বিরুদ্ধে মিডিয়া ও সুশীল সমাজ কর্তৃক তীব্র সমালোচনা করা হয়। আমাকে জেলে যেতে হয়েছিল। ফলে চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্তও হয়েছিলাম। দুদকের মামলা মোকাবেলা করতে প্রায় দুই বছর সময় লেগেছিল। আমার বিরুদ্ধে দুদকের প্রধান অভিযোগ ছিল, আমি অসদুদ্দেশ্যে আগের কয়েকটি মূল্যায়ন কমিটি ভেঙে নতুন কমিটি গঠন করি এবং কানাডার কোম্পানিকে কাজ পাইয়ে দেয়ার জন্য ‘দুর্নীতির ষড়যন্ত্র করি’। প্রফেসর জামিলুর রেজা চৌধুরীর নেতৃত্বে গঠিত যে কমিটি পদ্মা সেতুর বিভিন্ন প্যাকেজের টেন্ডার মূল্যায়ন করেছে তা ছিল বস্তুনিষ্ঠ, নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছ। বিশ্বব্যাংক কানাডার আদালতে সংশ্লিষ্ট কোম্পানির বিরুদ্ধে ‘দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের’ অভিযোগ করে। অবশেষে দুদকের তদন্ত ও কানাডার আদালতের রায়ে সব আসামি অব্যাহতি পান। দীর্ঘদিন মামলা চলমান অবস্থায় সুশীল সমাজের একাংশ ও মিডিয়া যত সমালোচনা করেছে, কোথাও জেআরসির নেতৃত্বে গঠিত মূল্যায়ন কিংবা তাদের সততা নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপিত হয়নি। যদি কমিটির মূল্যায়ন সঠিক থাকে, তবে আমরা দুর্নীতি করি কীভাবে? কমিটির মূল্যায়নের সুপারিশের ভিত্তিতেই যোগ্য ঠিকাদার নির্বাচিত হয়। আমি যে কমিটি করে দিয়েছিলাম, সে কমিটি এখন পর্যন্ত পদ্মা সেতু প্রকল্পের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। আমি সেতু বিভাগের সচিব থাকাকালীন আরো কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পের সূচনা হয়, যেগুলোর বাস্তবায়ন শুরু হয় আমি সেতু বিভাগ থেকে বদলি হওয়ার পর। উল্লেখযোগ্য দুটি প্রকল্প হলো ঢাকা-আশুলিয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে ও কর্ণফুলী টানেল প্রকল্প। আগের প্রকল্পগুলোর ধারাবাহিকতায় এ প্রকল্প দুটোর টেন্ডার মূল্যায়ন কমিটিরও সভাপতি করা হয় প্রফেসর জেআরসিকে। অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের বৃহৎ অবকাঠামো প্রকল্পেও বিশেষজ্ঞ পরামর্শক কমিটির প্রধান হিসেবে জেআরসিকে রাখা হতো। মোট কথা, বাংলাদেশের অধিকাংশ বৃহৎ প্রকল্প বাস্তবায়নে পরামর্শক কিংবা বাস্তবায়নপ্রধান হিসেবে জেআরসির কোনো না কোনো ভূমিকা থাকত। তিনি ছিলেন একজন কিংবদন্তিতুল্য অভিজ্ঞ সিভিল ইঞ্জিনিয়ার। তার অসংখ্য ছাত্র ও গুণগ্রাহী সর্বদা ছিলেন তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ। মৃত্যুর আগে তিনি এশিয়া প্যাসিফিক ইউনিভার্সিটির ভিসি হিসেবে কর্মরত ছিলেন।

ব্যক্তিগত জীবনে জেআরসি ছিলেন অত্যন্ত সহজ ও সাদাসিধা প্রকৃতির। কার্যোপলক্ষে আমি কয়েকবার তার ৬৮, এলিফেন্ট রোডের বাসায় গিয়েছি। তিনি এক ছেলে ও এক মেয়ের জনক। ছেলেমেয়ে উভয়েই প্রকৌশলী। ছেলে কাশিফ রেজা চৌধুরী দেশের একটি খ্যাতনামা পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত এবং মেয়ে কারিশমা ফারহিন চৌধুরী ব্রিটেনের ইউনিভার্সিটি অব লিডসের অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর। জেআরসির মৃত্যুতে দেশের অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে। তবে তার অবদান ও কীর্তির জন্য দেশবাসী তাকে দীর্ঘদিন স্মরণ করবে।

মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া: সাবেক সিনিয়র সচিব ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান

সৌজন্যে- বণিক বার্তা