টিপ যখন টিপ্পনীর শিকার 

প্রকাশ : 2022-04-10 10:47:40১ |  অনলাইন সংস্করণ

  নিউজ ডেস্ক   

টিপ যখন টিপ্পনীর শিকার 

কপালে টিপ পরা আমাদের বাঙালি সংস্কৃতির অন্যতম অনুষঙ্গ- এমনটি মনে করেন কেউ কেউ। আবার এর বিপরীত মতও আছে। তাদের মতে টিপ পরিধান করা হিন্দু-সংস্কৃতির অংশ, ইসলামে তা নিষিদ্ধ। এ বিতর্ককে গুরুত্ব না দিয়ে বলা যায়, কপালে টিপ পরা আমাদের এ উপমহাদেশের নারীদের রূপচর্চার অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণেত হয়েছে কালের বিবর্তনে। আমাদের মায়েরা তাদের শিশুসন্তানের কপালে কালো টিপ পরিয়ে থাকেন, যাতে শিশুর ওপর কারো বদনজর না পড়ে। তারা শিশুকে কোলে নিয়ে ছড়া কাটেন- ‘চাঁদের কপালে চাঁদ টিপ দিয়ে যা’। তার মানে কপালে টিপদেওয়া আমাদের সমাজের আবহমানকাল ধরেই চলে আসছে। আর মেয়েরা কপালে টিপ পরে তার সৌন্দর্যকে অধিকতর ফুটিয়ে তোলার মানসে। ছোট ছোট মেয়েশিশুরা সাজের যে জিনিসটির জন্য সবচেয়ে বেশি বায়না ধরে তা হলো টিপ। আগে টিপ পাওয়া যেত না। বড় বোন-ভাবীদের দেখতাম নেইল পলিশ দিয়ে অতি যত্ন সহকারে কপালে টিপ আঁকতে। এখন আর তা করতে হয় না। বাজারে নানা রং, নানা আকৃতি ও ডিজাইনের রেডিমেড টিপ কিনতে পাওয়া যায়; যেগুলোর পেছনে এক ধরনের হালকা আঠা লাগানো থাকে। তাই কপালে লাগাতে তেমন বেগ পেতে হয় না। স্ট্রিপ থেকে তুলে কপালে লাগিয়ে দিলেই হলো। কপালের টিপ নারীর সৌন্দর্যকে পরিপূর্ণ করে তোলে। কারো কারো মতে টিপ না পরলে বাঙালি নারীকে কেমন যেন অসম্পূর্ণ মনে হয়। টিপ পরার আবার একেকজনের একেক ধরন আছে। কেউ খুব ছোট্ট বিন্দুর মতো টিপ পরে, আবার কেউ এমনভাবে পরে যে, দুই ভ্রুর মাঝখানে এতটুকু ফাঁক থাকে না। 

টিপ পরা আমাদের দেশে আইনত নিষিদ্ধ কোনো কাজ নয়। এটা এই উপমহাদেশের নারীদের চিরাচরিত একটি শখের বিষয়। তবে, মুসলমান অনেক নারী কপালে টিপ পরা থেকে বিরত থাকেন। তাদের কাছে টিপ পরা ধর্মীয় রীতির লঙ্ঘন। নারীর কপালের এই টিপ কবি-সাহিত্যিকদের সৃষ্টিকর্মে এসেছে সৌন্দর্যের প্রতীক হিসেবে। লেখা হয়েছে কবিতা-গান। কেউ কেউ নারীর কপালের লাল টিপে দেখেছেন প্রভাতসূর্যের সৌন্দর্য্য।

 নারীর কপালের সেই টিপ এবার আমাদের সংবাদ মাধ্যমে শিরোনাম হয়েছে। এর প্রধান অনুঘটক পুলিশের এক সদস্য। গত ২ এপ্রিল তেজগাঁও কলেজের প্রভাষক ড. লতা সমাদ্দার ফার্মগেট এলাকা দিয়ে হেঁটে আসার সময় মোটর সাইকেল আরোহী পুলিশের পোশাক পরা একজন তাকে ‘টিপ পরছস কেন’ বলে কটুক্তি করে। তিনি এর প্রতিবাদ করলে সে লতা সমাদ্দারের পায়ের ওপর মোটর সাইকেল উঠিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। বিষয়টি জানিয়ে ওইদিনই শেরে বাংলা নগর থানায় জিডি করেন লতা সমাদ্দার। তবে জিডিতে তিনি ওই লোকের নাম-পরিচয় উল্লেখ করতে পারেন নি। এ ব্যাপারে পুলিশের পক্ষ থেকে গণমাধ্যমকে জানানো হয়েছিল, বিষয়টি তারা অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে নিয়েছেন এবং দোষীকে শনাক্ত করতে সর্বশক্তি নিয়োগ করেছেন। অবশেষে ড. লতা সমাদ্দারকে উত্যক্তকারী পুলিশ সদস্যের হদিস পাওয়া গেছে। ৪ এপ্রিল পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, তার নাম নাজমুল তারেক। সে পুলিশের  প্রটেকশন বিভাগে কর্মরত কনস্টেবল। নাজমুল তারেককে পুলিশ হেফাজতে নেওয়া হয়েছ।

এদিকে এই ন্যাক্কারজনক ঘটনা জনমনে তীব্র ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে। বিভিন্ন সংগঠন ঘটনার নিন্দা জানিয়ে অভিযুক্ত ব্যক্তির দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেছে। গণমাধ্যম এবং সামাজিক যোগাযোগমাধমে তাদের সে ক্ষোভের উত্তাপ ছড়িয়ে পড়েছে। মানবাধিকারকর্মী সুলতানা কামাল বলেছেন, ‘এ ধরনের ঘটনা থেকে প্রতীয়মান হয়, আমাদের রাজনীতি ও সামাজিক সংস্কৃতিতে সাম্প্রদায়িকতা এবং ভিন্নমত ও ভিন্ন পরিচয়ের প্রতি অসহিষ্ণুতাকে যথেষ্ট প্রশ্রয় দেওয়া হয়েছে’। তত্ত্ববাধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী বলেছেন, ‘স্বাধীনতার ৫০ বছর পর মুক্তিযুদ্ধের ধারক-বাহক সরকারের আমলে এ ধরনের ঘটনা শোনার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। এ ধরনের পশ্চাদপদ মানসিকতাকে অশনি সংকেত বলেই মনে হচ্ছে’। (সমকাল, ৪ এপ্রিল, ২০২২)।  ঘটনায় তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করে হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ ৭২ ঘণ্টার মধ্যে ওই পুলিশ সদস্যকে চিহ্নিত করে তার বিরুদ্ধে যথাযথ শাস্তিমূলক পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি জানিয়েছে। অন্যথায় এই ইস্যুতে তারা দেশব্যাপী তীব্র  আন্দোলন গড়ে তোলার হুমকি দিয়েছে। ‘নিপীড়নের বিরুদ্ধে শাহবাগ’ নামের একটি সংগঠনও জাতীয় জাদুঘরের সামনে সমাবেশ করে দোষী পুলিশ সদস্যের বিচার দাবিতে ৪৮ ঘণ্টার আল্টিমেটাম দিয়েছে। বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দলও ঘটনার নিন্দা জানিয়ে দোষী ব্যক্তির শাস্তি দাবি করে বিবৃতি দিয়েছে।

ঘটনা নিয়ে আলোচনা হয়েছে জাতীয় সংসদেও। ৩ এপ্রিলের অধিবেশনে আওয়ামী লীগ দলীয় সংরক্ষিত আসনের এমপি অভিনেত্রী সুবর্ণা মোস্তফা পয়েন্ট অব অর্ডারে ফ্লোর নিয়ে ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়ে অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘বাংলাদেশের কোন সংবিধানে কোন আইনে লেখা আছে নারী টিপ পরতে পারবে না? সুবর্ণা বলেছেন, নারী সমাজের জন্য এটি একটি অত্যন্ত ঘৃণিত ঘটনা। দেশে ইভটিজিংয়ের ঘটনা এখন অনেকটাই নিয়ন্ত্রিত। যখন দেশের আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী কাউকে ইভটিজিংয়ের ভূমিকায় দেখা যায়, তখন তা সবার জন্য অত্যন্ত লজ্জার’। নারী লাঞ্ছনার বিরুদ্ধে জনপ্রিয় এই অভিনেত্রীর সংক্ষুব্ধ প্রতিবাদ সাধুবাদ পাবার যোগ্য। তবে, বক্তৃতার সময় তার ‘ইভটিজিং’য়ের বাংলা প্রতিশব্দ খুঁজে না পাওয়া অনেককে বিস্মিত করেছে। ইভটিজিংয়ের বাংলা প্রতিশব্দ যে নারীকে উত্যক্ত করা- ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্রী সুবর্ণা তা জানবেন না, এটা অত্যন্ত দুঃখজনক। 

ভাবতে অবাক লাগে পুলিশের প্রটেকশন বিভাগে কর্মরত একজন সদস্য দেশের একজন নারীকে প্রটেকশন দেওয়ার পরিবর্তে তাকে হেনস্তা করতে দ্বিধা করল না! ঘটনাটিকে নিয়ে নানাজন নানা কথাবার্তা বলছেন। কেউ এজন্য ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গীকে দায়ী করছেন, কেউ বলছেন, রাষ্ট্রধর্ম বহাল থাকলে এধরনের ঘটনা ঘটতেই থাকবে। আবার কেউ কেউ এই ঘটনায় সাম্প্রদায়িকতার গন্ধ আবিস্কারেও মনোনিবেশ করেছেন। তাদের সাথে দৃঢ়ভাবেই দ্বিমত পোষণ করতে চাই। কেননা, কোনো নারীকে হেনস্তা করার পক্ষে কোনো ধর্মেরই সায় নেই। রাষ্ট্রধর্মও বলেনি যে, কোনো নারী টিপ পরলে তাকে অশালীন ভাষায় উত্যক্ত করতে হবে, তার গায়ের ওপর মোটর বাইক তুলে দিতে হবে। ঘটনাটি ঘটেছে সম্পূর্ণ বিকৃত মানসিকতা থেকে। নাজমুল তারেক নামের ওই পুলিশ সদস্যর নৈতিকতা শিক্ষা যে সম্পন্ন হয়নি, এ ঘটনা তারই প্রমাণ। একটি ডিসিপ্লিনড্ বাহিনীতে কাজ করা সত্ত্বেও সে একজন নারীর স্বাধীনতা এবং শালীন-অশালীন আচরণের প্রভেদ সম্পর্কে একেবারেই অজ্ঞ। আবার এমনও হতে পারে সে সবই জানে, কিন্তু তার রুচি বিকৃতি ঘটেছে এবং তারই বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে ফার্মগেটে। 

যে বিষয়টি অনেককে বিস্মিত করেছে তাহলো, ঘটনাটি নিয়ে কতিপয় ব্যক্তি ও সংগঠনের সাম্প্রদায়িকতার ধোঁয়া উড়িয়ে ফায়দা লোটার চেষ্টা। তারা ড. লতা সমাদ্দারকে কেবলই একজন হিন্দু নারী হিসেবে দেখাতে চাচ্ছেন। তিনি যে একই সঙ্গে একজন মানুষ, এদেশের একজন সম্মানিত নাগরিক এবং একজন শিক্ষক, তা যেন তারা ভুলেই গেছেন বা মনে থাকলেও সযত্নে এড়িয়ে যাচ্ছেন। একটি কথা পরিস্কার করেই বলা দরকার, লতা সমাদ্দার বখাটেদের ইভটিজিংয়ের শিকার এদেশের লাখ লাখ নারীর প্রতিচ্ছবি। আমরা সেইসব বখাটে ও বিকৃত রুচির পুরুষদের বিচার চাই, যারা মেয়েদের উত্যক্ত করে নিকৃষ্ট পৈশাচিক আনন্দ পায়। 

কারো কারো মন্তব্যে এটা স্পষ্ট যে, তারা নারীদের কপালে টিপ পরাকে কেবলই হিন্দু সংস্কৃতির অংশ মনে করছেন। বিষয়টি মোটেই তা নয়। হ্যাঁ, এটা ঠিক, এক সময় এদেশের মুসলমান নারীদের কপালে টিপ পরাকে গোনাহ্ মনে করা হতো। কিন্তু সময়ের বিবর্তন মানুষের আচার-আচরণ এবং সংস্কৃতিতেও পরিবর্তন এনেছে। এখন হিন্দু মুসলমান বৌদ্ধ খ্রিস্টান জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সব নারীই টিপ পরে। টিপ পরার জন্য আজ লতা সমাদ্দার উত্যক্তের শিকার হয়েছেন। কাল যে কোনো মুলমান মেয়ে একই পরিস্থিতির শিকার হবেন না, তার গ্যারান্টি কী? সুতরাং অপরাধকে অপরাধ হিসেবেই গণ্য করতে হবে। 

প্রসঙ্গক্রমে আরেকটি কথা বলা প্রয়োজন বোধ করছি। টিপ পরাকে যেমন বাঙালি সংস্কৃতির অংশ মনে করা হয়, তেমনি বোরখা এবং হিজাব পরিধান মুসলমান নারীদের পর্দা রক্ষার প্রধান অনুষঙ্গ। হিজাব নিয়ে এক শ্রেণির মানুষের মধ্যে আমরা এক ধরনের এলার্জি দেখি। তারা হিজাবকে পশ্চাৎপদতা, প্রগতিবিরোধী এবং ধর্মীয় মৌলবাদী চেতনার বহিঃপ্রকাশ বলে মনে করেন। এটা ঠিক ধর্মপ্রাণ নারীরা সাধারণত বোরখা বা হিজাব পরিধান না করে বাড়ির বাইরে বেরোন না। তার মানে এই নয় যে, তারা সবাই মৌলবাদী বা প্রগতিবেরোধী। রাস্তায় বেরোলে আজকাল কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের মেয়েদের হিজাব পরা অবস্থায় চলাচল করতে দেখা যায়। শিক্ষিত এবং উচ্চ পদস্থ অনেক নারীকেও হিজাব পরতে দেখা যায়। বাংলাদেশের সংবিধান বা কোনো আইনেও হিজাব পরিধান নিষিদ্ধ নয়। তারপরও কতিপয় অতিপ্রগতিবাদীকে মঝেমধ্যেই হিজাবের বিরুদ্ধে রীতিমতো বিপ্লবী বক্তৃতা করতে দেখা যায়। শুনতে কারো কারো কাছে তেতো লাগলেও স্বাধীন মত প্রকাশের অধিকার থেকেই বলছি, আজ যারা একজন নারীর টিপ পরা নিয়ে যেভাবে সোচ্চার হয়ে উঠেছেন, অতীতে হিজাব নিয়ে অনেক নিন্দনীয় ঘটনা ঘটলেও তাদেরকে টু শব্দটি করতে দেখা যায়নি। মনে রাখা দরকার, টিপ পরা যেমন একজন নারীর অধিকার, তেমনি হিজাব- বোরখা পরাও একজন নারীর অধিকার। নারীর অধিকারের পক্ষেই যদি আমাদের সোচ্চার হতে হয়, তাহলে সব নারীর পক্ষেই কথা বলা উচিত। 

পুলিশ কনস্টেবল নাজমুল তারেক ড. লতা সমাদ্দারকে টিপ পরার কারণে হেনস্তা করে যে ন্যাক্কারজনক ঘটনার জন্ম দিয়েছে, জাতি হিসেবে তা আমাদের জন্য লজ্জার। ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্ত হলেও আমরা যে মনোবিকৃতির কবল থেকে মুক্তি পাইনি, একজন পুলিশ সদস্যের এ আচরণ থেকে তা স্পষ্ট। ঘটনাটি যদি রাস্তায় ঘুরে বেড়ানো কোনো বখাটের দ্বারা সংঘটিত হতো আমরা অতটা অবাক হতাম না। কিন্তু যে ঘটিয়েছে, সে বাংলাদেশের একটি অন্যতম রাষ্ট্রীয় বাহিনীর সদস্য; যে বাহিনীর দায়িত্বই হলো দল-মত, জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব নাগরিকের জান-মাল-ইজ্জতের সুরক্ষা দেওয়া। দুঃখজনক হলেও সত্যটা বলতেই হয় যে, পুলিশ বাহিনীর অনেক সদস্যের বিরুদ্ধে আমরা নৈতিকস্খলনের যেসব অভিযোগ মাঝেমধ্যে গণমাধ্যমে পাই, নাজমুল তারেক তাদেরই একজন। স্বস্তির বিষয় হলো সে এখন পুলিশ হেফাজতে, তাকে সামযিক বরখাস্ত করে ঘটনার তদন্ত চলছে। তদন্তে সে দোষী সাব্যস্ত হলে তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে, এটা আশা করা যায়। আমাদের বোধ হয় সে পর্যন্ত ধৈর্য ধারণ করা উচিত। একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনাকে ইস্যু বানিয়ে সামাজিক অস্থিরতা যাতে কেউ সৃষ্টিরপ্রয়াস না পায়, সেদিকে গুরুত্ব দিতে হবে। 

 

লেখকঃ সাংবাদিক ও রাজনীতি বিশ্লেষক।