চোর সন্দেহে গণপিটুনিতে নিহত তোফাজ্জল মানসিক ভারসাম্যহীন ছিলেন
প্রকাশ : 2024-09-19 13:33:01১ | অনলাইন সংস্করণ
নিউজ ডেস্ক
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) এফএইচ হলের সামনে চোর সন্দেহে তোফাজ্জল হোসেন নামে এক যুবককে পিটিয়ে হত্যার অভিযোগ পাওয়া গেছে। গতকাল বুধবার মধ্যরাতে এ ঘটনা ঘটে।
তোফাজ্জল প্রেম সংক্রান্ত ব্যাপারে আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে মানসিক ভারসাম্যহীন ছিলেন। এর আগে তিনি ছাত্রলীগের বরগুনা জেলার পাথরঘাটা উপজেলার কাঠালতলী ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন। নিহত তোফাজ্জলের বাড়ি বরিশালের বরগুনা জেলার পাথরঘাটা উপজেলার কাঁঠাল তলি ইউনিয়নে। তাঁর বাবা-মা কেউ বেঁচে নেই।
বৃহস্পতিবার (১৯ সেপ্টেম্বর) বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সাবেক কেন্দ্রীয় যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী আরিফুজ্জামান আল ইমরান তার ফেসবুক একাউন্টে একটি স্ট্যাটাস দিয়ে এসব তথ্য জানান।
আরিফুজ্জামান আল ইমরান লেখেন, তোফাজ্জল আমার জন্মস্থান বরগুনা জেলার পাথরঘাটা উপজেলার সন্তান। তোফাজ্জল পাথরঘাটা উপজেলার কাঠালতলী ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সভাপতি। ব্যক্তিগত জীবনে প্রেম সংক্রান্ত একটি বিষয় নিয়ে আঘাতপ্রাপ্ত হওয়ায় প্রথমে কিছুটা মানসিক ভারসাম্য হারায়। এর কিছুদিনের মধ্যে খুব অল্প সময়ের ব্যবধানে তোফাজ্জলের মা, বাবা ও একমাত্র বড় ভাই মারা যান। তোফাজ্জল পরিবার ও অভিভাবক হারিয়ে পুরোপুরি মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে গত ৩ থেকে ৪ বছর ধরে।
তিনি লেখেন, বিগত ২ থেকে ৩ বছর তোফাজ্জল প্রায়ই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ঘুরে বেড়াত। আমাদের এলাকার যারা ওরে চিনতো সবাই সহযোগিতা করতো। ক্যাম্পাসে আমাকে দেখলেই দৌড়ে এসে কুশল বিনিময় করতো। আমি দেখা হলে ওরে খাবার খেতে বলতাম বা খাওয়ার জন্য টাকা দিতাম অথবা ও মাঝে মধ্যে চেয়ে নিত। খাবার ও খাবার টাকার বাইরে ওর তেমন কোনো চাহিদা ছিল না।
তিনি আরও লেখেন, হয়তো আজকেও খাবারের জন্য ও এফএইচ হলে গিয়েছিল। আজ আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুহসিন হলের ছোট ভাই সাংবাদিক কবির কানন এর ফেসবুক ওয়ালে তোফাজ্জলকে নিয়ে একটি স্ট্যাটাস দেখি যে তোফাজ্জলকে চোর সন্দেহে এফএইচ হলে আটক করেছে। আমি দেখা মাত্রই ফোন করে তোফাজ্জলের বিষয়ে কাননকে অবগত করি যে ও আমার এলাকার ছেলে, আমি ওরে ব্যক্তিগতভাবে জানি, বর্তমানে ও মানসিকভাবে ভারসাম্যহীন। হয়তো খাবারের সন্ধানে তোফাজ্জল এফএইচ হলে গেছে।
আমি কাননকে বলেছিলাম, কানন কিছুক্ষণ পরে আমাকে ফোন দিয়ে জানায় ভাই ওরে আর কেউ টর্চার করবে না, তবে আপনি ওর কোনো অভিভাবক কাউকে পাঠান যার কাছে তোফাজ্জলকে দিয়ে দেবে, আমি সেই ব্যবস্থা করছি। এরপর আমি আমাদের এলাকার বেশ কয়েকজনের সাথে যোগাযোগ করি এফএইচ হলে গিয়ে তাকে নিয়ে আসার জন্য কিন্তু শেষ পর্যন্ত কাউকে ম্যানেজ করতে পারিনি। ২ ঘণ্টার ব্যবধানে ফেসবুকে দেখি তোফাজ্জল এফএইচ হলের শিক্ষার্থীদের নির্মম নির্যাতনে মারা গিয়েছে।
পুলিশের ভাষ্য, ঢাবিতে চোর সন্দেহে গণপিটুনির শিকার হন এক যুবক। পরে গুরুতর অবস্থায় তাঁকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে নিয়ে আসলে মারা যান তিনি। বিষয়টি ঢাবি কর্তৃপক্ষ এবং সংশ্লিষ্ট থানা পুলিশকে জানানো হয়েছে।
জানা যায়, চোর সন্দেহে তাকে হলের প্রধান ভবনের অতিথিকক্ষে ও বর্ধিত ভবনের অতিথিকক্ষে কয়েক দফা পেটানো হয়। পরে থানায় নেওয়ার পর তার অবস্থা আশঙ্কাজনক দেখা দেয়। পরে তাকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে রাত ১২টা ৪৫ মিনিটে তার মৃত্যু হয়।
মৃত্যুর সময়টি নিশ্চিত করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর সহযোগী অধ্যাপক ড. সাইফুদ্দিন আহমেদ।
এর আগে, বুধবার হলের ক্রিকেট টুর্নামেন্ট ও ফুটবল টুর্নামেন্টের খেলা চলছিল। দুপুরের দিকে হলের ছয়জন শিক্ষার্থীর মোবাইল ফোন চুরি হয়। সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে তোফাজ্জল নামের ওই ব্যক্তি হলে এলে তাকে ফোন চুরি করার সন্দেহে আটক করে শিক্ষার্থীরা। এরপর রাত ৭টা ৪৭ থেকে ৪৮ মিনিটের সময় তাকে হলের প্রধান ভবনের অতিথিকক্ষে নেওয়া হয়। সিসিটিভি ফুটেজ থেকে প্রধান ভবনের অতিথিকক্ষে নেওয়ার সময়টি নিশ্চিত হওয়া গেছে। এরপর সেখানে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলে তিনি ফোন চুরির বিষয় অস্বীকার করেন। তখন তাকে এক দফা পেটানো হয়।
এরপর তাকে হলের ক্যান্টিনে খাবার খেতে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তাকে ডাল ও মাংস দিয়ে ভাত খাওয়ানো হয়। এরপর তাকে হলের বর্ধিত ভবনের অতিথিকক্ষে নেওয়া হয়। সেখানে তাকে কয়েক দফা পেটানো হয়। তখন স্টাম্প ও লাঠি দিয়ে পেটানো হয়। একপর্যায়ে তাকে আবারও হলের প্রধান ভবনের অতিথিকক্ষে নিয়ে আসা হয়। সেখানেও তাকে পেটানো হয়। রাত ১০টা ৫২ মিনিটে তাকে সেখান থেকে বের করে প্রক্টরিয়াল টিমের গাড়িতে তোলা হয়।
সিসি টিভি ফুটেজে দেখা যায়, এ সময় তিনি দুজনের কাঁধে ভর দিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হেঁটে গাড়িতে উঠছেন। তার শরীরে ছোট হাফ প্যান্ট ছাড়া অন্য কোনো কাপড় ছিল না। সেখান থেকে তাকে থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। থানায় ১৫ থেকে ২০ মিনিট অবস্থানের পর তার অবস্থা শঙ্কাজনক হলে তাকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে তিনি মারা যান।
সা/ই