ঘূর্ণিঝড় রেমালের তাণ্ডবে প্রাণ গেল ২১ জনের
প্রকাশ : 2024-05-28 14:24:59১ | অনলাইন সংস্করণ
নিউজ ডেস্ক
ঘূর্ণিঝড় রেমাল সোমবার উপকূলীয় বাংলাদেশ ও ভারতে ধ্বংসযজ্ঞ চালায়, যার ফলে ব্যাপক বন্যা হয় এবং অনেক ঘরবাড়ি, দেয়াল ও গাছপালা ঝড়ে ভেঙে পড়ে । মঙ্গলবার (২৮ মে) সকাল পর্যন্ত রাজধানীসহ ১০ জেলায় অন্তত ২০ জনের প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে।
রেমালের আঘাতে ঢাকায় ৪, ভোলায় ৩, বরিশালে ৩, পটুয়াখালীতে ৩, খুলনা, সাতক্ষীরা, চট্টগ্রাম, লালমনিরহাট, বরগুনা, কুষ্টিয়া ও কুমিল্লায় একজন করে মোট ২০ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে।
ঢাকাতেও ঘূর্ণিঝড় রেমালের প্রভাবে দেশের অন্যান্য জেলার মতোই ভারী বৃষ্টিপাত হয়েছে। আর এই বৃষ্টির মধ্যেই টিনের বেড়া, বৈদ্যুতিক খুঁটিতে স্পর্শ, বিদ্যুতের তারে জড়িয়ে এবং ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চার্জ দিতে গিয়ে চারজনের মৃত্যু হয়েছে। তারা হলেন- মরিয়ম বেগম (৪৫), লিজা আক্তার (১৫), মো. রাকিব (২৫) ও আলামিন (২২)। সোমবার (২৭ মে) রাতে রাজধানী ঢাকার খিলগাঁও, উত্তর বাড্ডায় ও যাত্রাবাড়িতে বিদ্যুৎস্পৃষ্টের আলাদা চারটি ঘটনায় তারা প্রাণ হারান।
বিদ্যুৎস্পৃষ্টে রাজধানীতে তিনজনের মৃত্যুর সত্যতা নিশ্চিত করেছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ পরিদর্শক বাচ্চু মিয়া। তিনি বলেন, ঘটনা তিনটির বিষয়ে সংশ্লিষ্ট থানাকে অবগত করা হয়েছে।
এদিকে উত্তর বাড্ডায় কাজ করে বাসায় ফেরার পথে রাস্তায় পড়ে থাকা বিদ্যুতের তারে জড়িয়ে আলামিনের মৃত্যু হয়েছে। ঢামেক হাসপাতালের পুলিশ ক্যাম্পের ইনচার্জ পরিদর্শক বাচ্চু মিয়া বলেন, মরদেহটি হাসপাতালে জরুরি বিভাগে রাখা হয়েছে। বিষয়টি রাতেই বাড্ডা থানা পুলিশকে জানানো হয়েছিল।
বরিশালে রেমালের তাণ্ডবে তিনজনের মৃত্যু হয়েছে। নগরের রুপাতলী এলাকায় সোমবার ভোর ৪টার দিকে একটি ভবনের ছাদের ওপরের নির্মাণাধীন দেয়াল ধসে পাশের খাবারের হোটেলের ওপর পড়ে দুইজনের মৃত্যু হয়েছে। তারা হলেন- লোকমান হোটেলের মালিক লোকমান হোসেন ও কর্মী মোকসেদুর রহমান। এ ঘটনায় শাকিব নামে এক হোটেলকর্মী আহত হয়েছেন। তাকে বরিশাল শেরে বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
তাছাড়া বাকেরগঞ্জ উপজেলার চর দাড়িয়ালের বাসিন্দা জালাল সিকদার (৫৫) গাছের ডাল পড়ে মারা গেছেন।
ভোলার তিন উপজেলায় শিশুসহ তিনজনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে লালমোহন উপজেলার পশ্চিম উমেদপুরে ঘর চাপা পড়ে আব্দুল কাদেরের স্ত্রী মনেজা খাতুন (৫৫), দৌলতখান পৌরসভার মনির হোসেনের চার বছরের মেয়ে মাইশা ও বোরহানউদ্দিন উপজেলার সাজড়া ইউনিয়নে গাছের ডাল পড়ে জাহাঙ্গীর হোসেন (৫০) মারা গেছেন। ভোলার জেলা প্রশাসক আরিফুজ্জামান ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করেছেন।
লালমনিরহাটের আদিতমারী উপজেলায় ঝড়ে গাছচাপায় রেজিয়া বেগম (৭২) নামের এক বৃদ্ধার মৃত্যু হয়েছে। সোমবার (২৭ মে) রাতে উপজেলার ভেলাবাড়ি ইউনিয়নের মহিষতুলি গ্রামে এ দুর্ঘটনা ঘটে। তিনি ওই গ্রামের তাহের উদ্দিন মুন্সির স্ত্রী।
সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার গাবুরা ইউনিয়নের নাপিতখালী আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়ার পথে শওকাত মোড়ল (৬৫) নামে এক বৃদ্ধের মৃত্যু হয়েছে। রোববার সন্ধ্যায় এ ঘটনা ঘটে। মৃত শওকাত মোড়ল গাবুরা ইউনিয়নের নাপিতখালী গ্রামের মৃত নরিম মোড়লের ছেলে। গাবুরা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জি এম মাসুদুল আলম এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
পটুয়াখালীতে ঘূর্ণিঝড় রেমালের প্রভাবে তিনজনের মৃত্যু হয়েছে। রোববার (২৬ মে) দুপুরের পর কলাপাড়ায় ফুফু ও বোনকে নিরাপদ স্থানে আনতে যাওয়ার পথে জোয়ারের পানিতে ডুবে মো. শরীফ (২৭) নামে এক যুবকের মৃত্যু হয়। ধূলাসর ইউনিয়নের কাউয়ারচর এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। মৃত শরীফ অনন্তপাড়া এলাকার আবদুর রহিমের ছেলে।
এছাড়া দুমকি উপজেলায় ঝড়ো হাওয়ায় গাছচাপায় জয়নাল হাওলাদার নামে এক বৃদ্ধের মৃত্যু হয়েছে। তিনি উপজেলার পাঙ্গাশিয়া ইউনিয়নের ৯নং ওয়ার্ড নলদোয়ানি স্লুইসগেট এলাকার বাসিন্দা।
এছাড়া বাউফলে ঝোড়ো হাওয়ায় একটি পরিত্যক্ত টিনশেড দোতালা ঘরের নিচে চাপা পড়ে আব্দুল করিম (৬৫) নামে এক বৃদ্ধের মৃত্যু হয়েছে। রোববার রাতে ঝড়ের সময় বৃদ্ধ করিম পরিত্যক্ত ওই ঘরে আশ্রয় নেন এবং রাতের যে কোনো সময় ঝোড়ো হাওয়ায় ঘর ভেঙে এ ঘটনা ঘটে। বাউফল পৌরসভার ৯ নং ওয়ার্ডের উপজেলা পরিষদ কমপ্লেক্সের কাছে এ ঘটনা ঘটে। বৃদ্ধ করিমের বাড়ি বাউফলের নাজিরপুর ইউনিয়নের ধানদি গ্রামে। তিনি ভিক্ষা করতেন।
কুমিল্লা নগরীতে নির্মাণাধীন একটি ভবনের দেওয়াল ধসে সাইফুল ইসলাম সাগর (১২) নামে এক শিক্ষার্থীর মৃত্যু হয়েছে। সোমবার বেলা ১১টার দিকে নগরীর শাকতলা এলাকায় নূর আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজে এ ঘটনা ঘটে। মৃত স্কুলছাত্র সাইফুল ইসলাম সাগর ওই প্রতিষ্ঠানের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র ছিল। সে শাকতলা এলাকার অলী আহমেদের ছেলে। কুমিল্লা সদর দক্ষিণ মডেল থানা পুলিশের পরিদর্শক (তদন্ত) খাদেমুল বাহার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
চট্টগ্রাম নগরীতে দুইজনের মৃত্যু হয়েছে। নগরীর বায়েজিদ এলাকায় নির্মাণাধীন ভবনের দেয়াল ধসে সাইফুল ইসলাম হৃদয় (২৬) নামে এক যুবক মারা গেছেন। সোমবার সকাল সাড়ে ৮টার দিকে বায়েজিদের চন্দ্রনগর কলাবাগান এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। তিনি নির্মাণাধীন ভবনের পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় ধসে পড়া দেয়ালে চাপা পড়েন। বায়েজিদ ফায়ার স্টেশনের সিনিয়র স্টেশন অফিসার মো. কামরুজ্জামান ঢাকা পোস্টকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
এছাড়া নগরের কোতোয়ালি থানা এলাকায় খালে তলিয়ে অজ্ঞাতনামা এক যুবক মারা গেছেন। একইদিন দুপুরে থানার আছাদগঞ্জ শুটকিপট্টি চাক্তাই খালে এ ঘটনা ঘটে। এ বিষয়ে চমেক হাসপাতাল পুলিশ ফাঁড়ির উপ-পরিদর্শক (এসআই) নুরুল আলম আশেক বলেন, পানিতে ডুবে আহত একজনকে বিকেলে হাসপাতালে আনেন স্থানীয়রা। পরে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেছেন।
কুষ্টিয়ার মিরপুরে ঘূর্ণিঝড় রেমালে টিনের চালার নিচে পড়ে বাদশা মল্লিক (৬০) নামের এক বৃদ্ধের মৃত্যু হয়েছেন। সোমবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে উপজেলার চিথলিয়া ইউনিয়নের দাসপাড়া এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। নিহত বাদশা মল্লিক চিথলিয়া ইউনিয়নের তিন নম্বর ওয়ার্ডের দাসপাড়া এলাকায় মৃত খবির মল্লিকের ছেলে। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন চিথলিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এনামুল হক বাবলু।
বরগুনা জেলার সদর উপজেলায় ঘরের উপর পড়া গাছ সরাতে গিয়ে আব্দুর রহমান বয়াতি (৫৬) নামে একজনের মৃত্যু হয়েছে। তিনি আয়লা পাতাকাটা ইউনিয়নের ৪নং ওয়ার্ডের লেমুয়া গ্রামের মৃত খুতি বয়াতির ছেলে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শামীম মিঞা বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
খুলনায় ঘূর্ণিঝড় রেমালের প্রভাবে তীব্র বাতাস ও বৃষ্টিতে গাছ উপড়ে ঘরের ওপর পড়ে লালচাঁদ মোড়ল (৩৬) নামের একজনের মৃত্যু হয়েছে। রোববার রাতে উপজেলার সুরখালী ইউনিয়নের ২নং ওয়ার্ডের গাওঘরা গরিয়ারডাঙ্গা গ্রামে এ ঘটনা ঘটে। লালচাঁদ মোড়ল গরিয়ারডাঙ্গা গ্রামের গহর মোড়লের ছেলে। তিনি কৃষিকাজ করতেন। অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মো. নাজমুল হুসেইন খাঁন বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
প্রসঙ্গত, বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট প্রবল ঘূর্ণিঝড় রেমাল উপকূলে ব্যাপক তাণ্ডব চালিয়েছে। গত রোববার বিকেল নাগাদ ঝড়টির প্রভাব শুরু হয়, আর রাতে ঝড়টির কেন্দ্র উপকূলে আঘাত করা শুরু করে। ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে উঁচু জলোচ্ছ্বাস ভাসিয়ে দিয়েছে জনপদ। অনেক এলাকায় বেড়িবাঁধ ভেঙে গেছে। বিদ্যুৎবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন প্রায় ৩ কোটি মানুষ। ইন্টারনেট সংযোগের বাইরে কয়েক লাখ মানুষ।
মোট ১৯টি জেলা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত উপজেলার সংখ্যা ১০৭ এবং ইউনিয়ন ও পৌরসভার সংখ্যা ৯১৪টি।
সা/ই