গ্রাম বাংলার ঐতিহ্য ও চিরচেনা তালগাছ এখন বিলুপ্তির পথে
প্রকাশ : 2021-09-02 19:35:17১ | অনলাইন সংস্করণ
নিউজ ডেস্ক
তাল গাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে, সব গাছ ছাড়িয়ে, উঁকি মারে আকাশে-তাল গাছ সম্পর্কে এমন ভাবে আর কে-ই বা ভেবেছেন রবীন্দ্রনাথ ছাড়া? গ্রাম বাংলার অতিচিরচেনা ফল তাল। আকাশ পানে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা সারি সারি তালগাছ আর গাছে-গাছে ধরা তালফল ও বাবুই পাখির ঝুলন্ত বাসা কতনা মনোহর এবং পাখির কলতান কার না ভালো লাগে। তালের আদি নিবাস আফ্রিকা হলেও বাংলাদেশের সকল স্থানে ছোট বড় কম বেশী তালগাছ এখনও চোখে পড়ে। এমন এক অকৃত্রিম দৃশ্য সত্যিই মানুষের মন ভোলানো দৃশ্য বগুড়ার আদমদীঘি উপজেলার সান্তহার সাইলো রোড। এমন মাটি ও গাছ-পালার দৃশ্য দেখলে সকলের হৃদয়কে নাড়া দেবেই। মনমুগ্ধকর তালগাছের এমন দৃশ্য দেখে খান মুহম্মদ মঈনুদ্দিন এর সেই কবিতার কথায় মনে করিয়ে দেয়- ‘ঐ দেখা যায় তালগাছ ঐ আমাদের গাঁ, ঐ খানেতে বাস করে কানা বগীর ছা।’
তালের চারা রোপন করে তা থেকে ফল ও সারবান কাঠ আমাদের সব সময় কাজে লাগে। বর্তমানে এ গাছটির চাষ করতে অনেকেরই এখন অনিহা দেখা যায়। তবে এব্যাপারে প্রতি বছরই সরকারি ভাবে উপজেলা কৃষি অফিসের পক্ষ থেকে কিছু কর্মসূচী পালন করা হলেও নিজ উদ্যোগে এখন আর কেউ তালগাছের চারা রোপন করতে চায় না। প্রতিবছর বৃক্ষ রোপন মৌসুমে অন্যান্য বৃ¶ চারার সহিত যদি তালগাছের বীজ/চারা বেশী বেশী করে সকলে মিলে রোপন করা যায় আর নির্বিচারে যদি তালগাছ নিধন না করা হয় তাহলে আমাদের এ দেশে আবারও উপকারী ফল তালগাছ ফিরে পাবে হারানো ঐতিহ্য। তার সাথে নিশ্চিত হবে আগামীর খাদ্য পুষ্টি, অর্থ ও সমৃদ্ধি। এই তাল বৃক্ষটি তার শিশুকাল থেকেই এর রোপন ও পরিচর্চাকারীকে অর্থনেতিক কর্মকান্ডে বিভিন্নভাবে সহায়তা করে থাকে। তালফল ও তালগাছের বহুবিধ ব্যবহার ও পুষ্টি গুনাগুন বিবেচনায় দেশীয় ফলের মাঝে তালের অবদান শীর্ষে। অজ্ঞতা ও দৈনন্দিন বিভিন্ন কাজের চাহিদার কারণে দিন দিন যেভাবে তালগাছ নিধন করা হচ্ছে এতে প্রকৃতি পরিবেশ হারাচ্ছে তার অপরূপ সৌন্দর্য। নয়নাভিরাম সারি সারি তালগাছ, গাছে গাছে তাল ফল ও তালগাছে বাবুই পাখির বাসা আজ আর তেমন চোখে পড়ে না। শুধু এতেই শেষ না, পাখিদের নিরাপদ নিবিড় আবাস গড়বে তালগাছের নিবিড় বনায়ন। তালগাছের বিশেষ বৈশিষ্ট্য ও নিরাপত্তার জন্যই তো কারিগরি বাবুই পাখীরা এত সব গাছ থাকতে একমাত্র তাল গাছকেই বেছে নিয়েছে বসবাসের নিরাপদ স্থান হিসাবে। গুচ্ছ মূলী বৃহৎ অশাখ বৃক্ষ তালগাছের গোড়ার দিক মোটা, উপরের অংশ তুলনামূলক চিকন, কান্ডের মাথায় বোটা ও পাতা গুচ্ছ ভাবে সাজানো থাকে ও বোটার দু-ধারে করাতের মতো দাঁত আছে, বোটা শক্ত ও খুব পুরু। গাছ উচ্চতায় ২০ থেকে ২৫ মিটার হয়ে থাকে এবং দীর্ঘ জীবি উদ্ভিদের মাঝে অন্যতম হচ্ছে তালগাছ। ১৪০ থেকে ১৫০ বছর বয়স পর্যন্ত বেঁচে থাকে। তুলনামূলক ভাবে রোগ বালাইও কম। তালগাছ পুরুষ ও স্ত্রী উভয় লিঙ্গ গাছ, একই গাছে দু-রকম ফুল ফুটেনা। পুরুষ গাছে ফুল হয়, ফল হয়না, ফুল জটা নামে পরিচিত। মঞ্জুরির রঙ হলুদ, লম্বা আকৃতির, বসন্তে গাছে ফুল ধরে। তালগাছের বৃদ্ধি ধীর গতি সম্পন্ন, বীজ রোপনের ১০ থেকে ১৫ বছর বয়সে গাছে ফল ধরে। তাল ফলে এক থেকে দুটি বা তিনটি আঁটির ফল ধরতে দেখা যায়। ফল পাকে ভাদ্র মাসে, তবে কোন কোন গাছে বছরের অন্যসময় ফল ধরতে দেখা যায়। পাকা ফলের ঘ্রাণ তিব্র সু-গন্ধযুক্ত, স্বাধে মিষ্টি থেকে পানসে মিষ্টি হয়। প্রায় সব ধরনের মাটিতে তাল গাছ জন্মে। সহজ রোপন পদ্ধতি, কষ্ট সহিষ্ণু, কম যত্নে উৎপাদন ও বৃদ্ধির ফলে গ্রামীণ সড়ক, মহাসড়ক, বাঁধ বেড়িবাঁধ, রেল লাইন, পুকুর পাড়, খালের পাড়, নদীর পাড়, জমির আঁইল, পতিত জমি ও বসতবাড়ীর শেষ সীমানায় তালগাছ রোপন উপযোগী স্থান।
উল্লেখ্য, তালের পাতা দিয়ে হাত পাখা, মাদুর, টুপি, ঘরের ছাউনী, চাটাই, ছাতা, লাকরী হিসেবে ব্যবহৃত হয়। গাছের ফাইবার বা আঁশ থেকে বিভিন্ন রকমের সৌখিন সামগ্রী তৈরি হয়, যথা- টুপি, ঝুড়ি, ব্রাশ পাপোষ, ছোট বাষ্কেট, ও মাছ ধরার খলশানীতে ব্যবহৃত হয়। পুরুষ গাছের ফুল বা জটা হতে রস সংগ্রহ করে তা দিয়ে গুড়, পাটালি, ভিনেগার, পিঠা, বড়া, লুচি, ইত্যাদি তৈরি করা হয়। পাকা তালের রস দিয়ে পিঠা, বড়া, খির, পায়েস তৈরি করা হয়। কচি ও কাঁচা তালের নরম শাঁস মুখরোচক পুষ্টিকর ও ছোট বড় সবার প্রিয়। এছাড়া গ্রীষ্মের তৃষ্ণা নিবারনে কাজ করে। তাল গাছের গোড়ার অংশ দিয়ে ডিঙ্গি নৌকা তৈরি, শক্ত ও মজবুত বলে ঘরের খুটি, আড়া, রুয়া, বাটাম, কৃষকের লাঙ্গলের ঈষ তৈরি করা হয়। গাছ শক্ত মজবুত গভীর মূলী বলে ঝড় তুফান, টর্নেডোর বাতাস প্রতিরোধ ও মাটি ¶য় রোধে তালের গাছের ভূমিকা অতুলনীয়। বিশেষ করে বজ্রপাত প্রতিরোধ করে এবং মৃত্যুর কবল থেকে রক্ষা করে। তাল ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ পুষ্টিকর খাবার, তালের রস শেন্টমানাশক, সূত্র বর্ধক, প্রদাহ ও কোষ্ঠ কাঠিন্য নিবারণ করে। রস থেকে তৈরি তাল মিসরি সর্দি কাশিতে মহৌষুধ হিসেবে কাজ করে। যকৃতের দোষ নিবারক ও পিত্তনাষক হিসেবেও কাজ করে থাকে।