গণহারে আক্রান্ত হচ্ছে তরুণরা, মৃত্যু বাড়ছে বয়স্কদের
প্রকাশ : 2021-04-11 09:51:10১ | অনলাইন সংস্করণ
নিউজ ডেস্ক
দেশে করোনা আক্রান্ত হয়ে একদিনে সর্বোচ্চ মৃত্যু হয়েছে শনিবার। এদিন ৭৭ জনের মৃত্যুর কথা জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। মৃতদের মধ্যে ৪৪ জনই ষাটোর্ধ। তাছাড়া ১৩ মার্চের পর থেকে বয়স্কদের মৃত্যুহার দ্বিগুণ হতে থাকে এবং ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকে। আর আইইডিসিআর’র পর্যবেক্ষণ বলছে আক্রান্তদের মধ্যে প্রায় ৬৯ শতাংশই তরুণ-মধ্যবয়সী। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে ইউকে ভ্যারিয়েন্ট এবং সাউথ আফ্রিকান ভ্যারিয়েন্টের কারণে এমনটি হচ্ছে। আগে ১ জন থেকে ১০ জন সংক্রমিত হলেও এখন ভ্যারিয়েন্টের কারণে ১০ জন থেকে ১৬ জন আক্রান্ত হচ্ছে।
গড়ে ৫৬ জন মারা যাচ্ছে
স্বাস্থ্য অধিদফতরের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, এখন পর্যন্ত মোট মৃত্যুর ৫৬ দশমিক ২০ শতাংশই ষাটোর্ধ। এছাড়া ৫১ থেকে ৬০ বছরের মধ্যে আছে ২৪ দশমিক ৬১ শতাংশ, ৪১ থেকে ৫০ বছরের মধ্যে ১১ দশমিক ১২ শতাংশ, ৩১ থেকে ৪০ বছরের মধ্যে ৪ দশমিক ৯৭ শতাংশ, ২১ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে ১ দশমিক ৯৭ শতাংশ, ১১ থেকে ২০ বছরের মধ্যে শূন্য দশমিক ৭৩ শতাংশ এবং শূন্য থেকে ১০ বছরের মধ্যে শূন্য দশমিক ৪০ শতাংশ। এপ্রিল মাসের ১০ দিনেই গড়ে মারা গেছেন ৫৬ জন।
১৩ দিনে রেকর্ড ভেঙেছে ৯ বার
অন্যদিকে বর্তমানে দৈনিক সংক্রমণের হার ২০ দশমিক ৪৯ শতাংশ। স্বাস্থ্য অধিদফতরের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, গত ২৯ মার্চ অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে করোনা শনাক্ত হয় ৫ হাজার ১৮১ জন, সেই রেকর্ড ভেঙ্গে আবার ৩১ মার্চ শনাক্ত হয় ৫ হাজার ৩৮৫ জন। ১ এপ্রিল শনাক্তের রেকর্ড ভেঙে দাঁড়ায় ৬ হাজার ৪৬৯ জন। ২ এপ্রিল আবারও আগের রেকর্ড ভেঙে শনাক্ত দাঁড়ায় ৬ হাজার ৮৩০ জন। এরপর ৪ এপ্রিল সব রেকর্ড ভেঙে সাত হাজার ছাড়িয়ে একদিনে শনাক্ত দাঁড়ায় ৭ হাজার ৮৭ জন। মঙ্গলবার রেকর্ড ভেঙে শনাক্ত হয় ৭ হাজার ২১৩ জন এবং গত বছরের মৃত্যুর রেকর্ড ভেঙে দাঁড়ায় ৬৬ জনে। এরপর বুধবার আবারও সেই রেকর্ড ভাঙে করোনার শনাক্ত। বৃহস্পতিবার অতীতের সব মৃত্যুর রেকর্ড ভাঙে, এদিন মারা যায় ৭৪ জন। এরপর আজ শনিবার সেদিনের মৃত্যুর রেকর্ড ভাঙে।
তরুণদের আক্রান্ত হওয়ার হার বেশি
রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) দেওয়া তথ্য অনুযায়ী একদিনে শনাক্তে প্রায় ৬৯ শতাংশ পাওয়া গেছে ১৯ থেকে ৪৮ বছর বয়সীদের মধ্যে। ২৭ শতাংশ পাওয়া গেছে ৪৯ বছরের উপরে এবং ৪ দশমিক ২ শতাংশ শূন্য থেকে ১৮ বছর বয়সীদের মধ্যে।
বাজার এবং গণপরিবহণ থেকে সংক্রমণের হার বেশি
আইইডিসিআরের প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, বাজার ও গণপরিবহণ থেকে করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি রয়েছে ৬১ শতাংশ। অন্যদিকে জনসমাগমস্থল থেকে করোনা ছড়ানোর ঝুঁকি শতকরা ৩৫ ভাগ। আইইডিসিআর জানায়, গত ৫ মার্চ থেকে ৫ এপ্রিল পর্যন্ত প্রায় সাড়ে আট হাজার করোনা রোগীর তথ্য পর্যালোচনা করে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। গবেষণা প্রতিষ্ঠানটি বলছে, শনাক্ত রোগীদের মধ্যে ৬০ শতাংশেরই বাজারে যাওয়া এবং গণপরিবহন ব্যবহারের ইতিহাস আছে। গণপরিবহন ও বাজারের বাইরেও সভা-সেমিনারসহ অন্য জায়গা থেকেও করোনায় সংক্রমিত হওয়ার আশঙ্কার কথা জানিয়েছে আইইডিসিআর।
সরকারের পাবলিক হেলথ এডভাইজরি কমিটির সদস্য ও জ্যেষ্ঠ জনসাস্থ্যবিদ অধ্যাপক আবু জামিল ফয়সাল গণমাধ্যমকে বলেন, সাউথ আফ্রিক্যান ভ্যারিয়েন্টের ধর্মই তরুনদের বেশি সংক্রমিত করে। সাউথ আফ্রিকান ভ্যারিয়েন্ট যেখানেই পাওয়া গেছে সেখানে দেখা গেছে, তরুনদের বেশি সংক্রমিত করে এবং তার সিভিয়ারিটি অর্থাৎ জটিলতা বেশি। কিন্তু করোনাতে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর তালিকায় ষাটোর্ধ্বদের বেশি থাকার কারণ হচ্ছে তারা আগে থেকেই অন্যান্য জটিল রোগে আক্রান্ত থাকেন। অন্যান্য অসুখে ভোগার কারণে তাদের টিকে থাকাটা খুব কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।
আইডিসিআর’র উপদেষ্টা ডা মুশতাক হোসেন বলেন, গত জানুয়ারি ফেব্রুয়ারি মাসে আমরা বিভিন্ন কমিউনিটি সেন্টারে বিভিন্ন বদ্ধ জায়গায় প্রচুর পারিবারিক সামাজিক রাজনৈতিক অনুষ্ঠান করেছি। কাজেই ঐ জায়গায় মানুষ যদি বেশি জড়ো হয় সংক্রমণ দ্রুত ছড়ায়। সেটারই প্রভাব আমরা এখন দেখছি। আগে যেগুলো ঘটনা ঘটেছে সেগুলোর প্রভাব আমরা এখন দেখতে পারছি। এখন যা হচ্ছে তার প্রভাব আমরা এক সপ্তাহ পরে দেখতে পারবো।
তিনি আরও বলেন, ভ্যারিয়েন্টের কারণে ছড়াচ্ছে বেশি। আগে ১ জনের কাছ থেকে ১০ জন সংক্রমিত হতো এখন ১০ জনের কাছ থেকে ১৬ জন সংক্রমিত হচ্ছে। শতকরা ৬০ ভাগ বেশি। যদি মানুষের সঙ্গে মানুষের সংস্পর্শে আসতে বাঁধা দেওয়া হয় তাহলে তো ভ্যারিয়েন্ট কাজ করা কথা না। যেসব রোগী শনাক্ত হচ্ছে তাদের সবাইকে চিকিৎসার আওতায় আনতে হবে। তারা যেন ঘোরাফেরা না করে এবং তাদের আইসোলেশন নিশ্চিত করতে হবে। বাসায় রাখতে হবে, যাদের সম্ভব হবে না তাদেরকে ফিল্ড হাসপাতালে নিয়ে আসতে হবে।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. বেনজির আহমেদ বলেন, এখন যে হারে সংক্রমণ হচ্ছে তার অন্যতম কারণ ভ্যারিয়েন্ট। আমাদের চিকিৎসক নার্সদের অভিজ্ঞতা আগের চেয়ে বেড়েছে। প্রথমদিকে অনেক অভিজ্ঞতা কম ছিল। সুতরাং ম্যানেজমেন্টের কারণে যে মৃত্যু বেশি হচ্ছে সেটা মনে হচ্ছে না। ভ্যারিয়েন্টের কারণে রোগের প্যাটার্ন অন্যরকম হয়ে গেছে। যার কারণে বয়স্কদের মৃত্যু বেড়েছে, তরুণ জনগোষ্ঠী ব্যাপকভাবে আক্রান্ত হচ্ছে এবং আগের তুলনায় বেশি হাসপাতালের সাপোর্ট লাগছে। আগে কিন্তু আমরা তরুণদের হাসপাতালের প্রয়োজন কম দেখেছি। এটা আরও হয়তো সামনের দিনগুলোতে স্পষ্ট হবে। আমাদের এজন্য জিনোম সিকোয়েন্স বাড়াতে হবে। যাতে আমরা বুঝতে পারি কোন ভ্যারিয়েন্ট কোথায় কেমন এবং যারা আক্রান্ত হচ্ছে তাদের ব্যাকগ্রাউন্ড কেমন। সেই সঙ্গে টিকা নিয়েছিল কিনা সেসব বিশ্লেষণ করা দরকার। কারণ আমার ধারণা আগামী আরও ৭-৮ মাস আমাদের এটা হয়তো মোকাবিলা করতে হবে।