কীভাবে প্রতিষ্ঠা হয়েছিল সার্চ ইঞ্জিন গুগলের
প্রকাশ : 2021-03-25 10:34:18১ | অনলাইন সংস্করণ
নিউজ ডেস্ক
গুগল হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে জনপ্রিয় সার্চ ইঞ্জিন। কিন্তু কীভাবে শুরু হয়েছিল এই গুগলের যাত্রা? কার মাথায় এসেছিল এমন একটা কিছু চালু করার চিন্তা? এর সূচনা করেছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ার স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই ছাত্র, যারা তখন পিএইচডি করছিলেন। তাদের হাতে সৃষ্টি হয়েছিল পৃথিবীর অন্যতম মূল্যবান কোম্পানি গুগলের । এ দু’জনের নাম ল্যারি পেজ আর সের্গেই ব্রিন।
গুগলের ওই দুই প্রতিষ্ঠাতার সাথে একই সময় স্ট্যানফোর্ডে ছিলেন একজন কম্পিউটার বিজ্ঞানী তামারা মাঞ্জনার। কীভাবে ল্যারি আর সের্গেই একটা নতুন ধরনের সার্চ ইঞ্জিনের আইডিয়া নিয়ে এসেছিলেন, তারই স্মৃতিচারণ করেছেন তিনি বিবিসির ফারহানা হায়দারের কাছে। এ নিয়েই ইতিহাসের সাক্ষীর এ পর্ব।
বৈপ্লবিক পরিবর্তন
সেটা ১৯৯০ দশকের মাঝামাঝি। স্ট্যানফোর্ডের দুজন পোস্টগ্রাজুয়েট ছাত্রের মাথায় এমন একটা আইডিয়া এলো যা এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন নিয়ে এসেছিল ইন্টারনেটের জগতে।
সের্গেই ব্রিন বলেন, ‘আমাদের সবসময়ই মনে হয়েছিল যে এরকম একটা উদ্যোগের ব্যবসায়িক সম্ভাবনা আছে। কিন্তু সে সময়টা আমাদের চিন্তা ছিল একটা খুব ভালো সার্চ ইঞ্জিন তৈরি করা, এবং যত বেশি সম্ভব লোকের কাছে তা পৌঁছানো।’
ল্যারি পেজের কথায়, ‘আমাদের মিশন ছিল বিশ্বের তথ্যকে সুবিন্যস্ত করা, যেখানে সারা দুনিয়ার লোক ঢুকতে পারবে, সবার উপকার হবে। আমার মনে হয়েছিল সারা পৃথিবীর জন্য এটা একটা দারুণ ব্যাপার হবে।’
তামার বলছিলেন, ‘ল্যারি খুব হাসতো। ও ছিল খুব বুদ্ধিমান, কিন্তু মজার। আর সের্গেই ছিল একটু সিরিয়াস। কিন্তু দু’জনেরই মধ্যে এরকম একটা ভাব ছিল যে ‘আমরা আমাদের মত করে কাজটা করতে চাই’। এটা হয়তো তাদের ব্যক্তিত্বের একটা অংশ ছিল এবং এ জন্যই গুগল এত অন্যরকম একটা জায়গা হয়ে উঠতে পেরেছে।’
সিলিকন ভ্যালিতে তখন সৃষ্টির প্রাণচাঞ্চল্য
ল্যারি পেজের জন্ম মিশিগান অঙ্গরাজ্যে। আর সের্গেই ব্রিনের জন্ম হয়েছিল রাশিয়ায়। তবে দুজনেরই বাবা-মায়েরা ছিলেন শিক্ষাবিদ এবং দুজনেই স্ট্যানফোর্ডে এসেছিলেন কম্পিউটারে সায়েন্সে পিএইচডি করতে। তাদের প্রথম পরিচয় হয় ১৯৯৫ সালে। তখন ক্যালিফোর্নিয়ার সিলিকন ভ্যালি ছিল এক উজ্জ্বল সম্ভাবনার জায়গা।
‘সবখানেই একটা প্রাণচাঞ্চল্য, সবখানেই নতুন কিছুর জন্ম হচ্ছে। সবকিছুই সম্ভব। ১৯৯০এর দশকের মাঝামাঝি সময়টার সবচেয়ে দারুণ ব্যাপারটা ছিল যে কোন একটা পার্টিতে গেলেই একাধিক দারুণ এবং আকর্ষণীয় চাকরির অফার পেয়ে যেতেন । কাজেই প্রতি সপ্তাহেই আমাকে মনে মনে নতুন করে একটা প্রতিজ্ঞা করতে হতো যে কোন অবস্থাতেই গ্র্যাড স্কুলের পড়াশোনা ছেড়ে দিলে চলবে না’ বলছিলেন তামারা।
‘সবখানেই তখন স্টার্ট-আপ - মানে নতুন কিছু একটা ব্যবসা শুরু করা - প্রায় বিস্ফোরণের মত। তখনকার গ্র্যাজুয়েট কোর্সের ছাত্রদের এক-চতুর্থাংশই তখন কিছু-না-কিছু স্টার্ট-আপ করছে।’
‘ফ্যাকাল্টিগুলোওর তখন স্টার্ট-আপ ছিল। কাজেই স্ট্যানফোর্ডের প্রফেসরদের বেশির ভাগই তখন তাদের আগেকার স্টার্ট-আপের আয়ের কারণে মাল্টি-মিলিওনিয়ার হয়ে গেছেন। একজন কম্পিউটার বিজ্ঞানীর জন্য সেটা ছিল এক আশ্চর্য জায়গা।’
‘খুব সহজেই তর্ক বেধে যেতো তাদের’
স্ট্যানফোর্ডে ল্যারি পেজ এবং তারো তিন জনের সাথে একই অফিসে কাজ করতেন তামারা। ‘ল্যারির সাথে দেখা হলে আপনার সের্গেইয়ের সাথে দেখা হবেই - কারণ ওদের সবসময়ই এক সাথে দেখা যেতো। তখনও কিন্তু তাদের বন্ধুত্বটা ঠিক সরল রেখা্য় চলতো না।’
দু'জনই পরে বলেছেন, প্রথম তাদের যখন দেখা হয়েছিল তখন তাদের একের অপরকে একেবারেই পছন্দ হয়নি। ‘তাদের মধ্যে খুব সহজেই তর্ক বেধে যেতো’ বলেন তামারা। ১৯৯৬ সালে পেজ আর ব্রিন একটি থিসিস প্রকল্প শুরু করলেন - কিভাবে ইন্টারনেটে বিভিন্ন পেজ খুঁজে পাবার প্রক্রিয়াটাকে উন্নত করা যায়।
‘সার্চ ইঞ্জিন বলে তখন প্রায় কিছুই ছিল না’
এখন এটা কল্পনা করা মুশকিল, কিন্তু ইন্টারনেটের প্রথম যুগে কোন কিছু খুঁজে পাবার প্রক্রিয়াটা ছিল খুবই বিশৃঙ্খল এবং খুব ঝামেলার। কারণ তখনকার দিনে সার্চ ইঞ্জিন বলে কিছু ছিল না।
তামারার কথায়, ‘আজকালকার লোকেরা হয়ত বুঝবে না যে তখনকার ইন্টারনেট কেমন ছিল। আসলে আক্ষরিকভাবেই তখন সার্চ বলে কিছু ছিল না। আপনাকে কিছু পেতে হলে হাতে তৈরি ইনডেক্স বা সূচি থেকে কোন কিছু খুঁজে বের করতে হতো। ইন্টারনেটের দুনিয়া তখন এত ছোট ছিল যে আমার ওয়েবপেজে কেউ ক্লিক করলে আমি তা লগ করে রাখতাম, কি উত্তেজনা - আমার ওয়েবপেজে কেউ একজন ক্লিক করেছে !’
পেজ আর ব্রিন বুঝতে পারলেন, কেউ যখন কোন ওয়েবপেজ থুঁজছে তখন সেটা যে শুধু প্রাসঙ্গিক হতে চায় তাই নয়, বরং সেটা আগেকার ব্যবহারকারীদের চোখে মূল্যবান কিনা তাও দেখা হয়।
‘যেমন আপনি যখন ‘কিভাবে চকলেট কেক তৈরি করতে হয় বলে সার্চ দিচ্ছেন, আপনি শুধু যে চকলেট কেক কথাটা আছে এমন পেজ খুঁজছেন তাই নয়, আপনি চান সেই পেজটা যাতে সেরা চকলেট কেক বানানোর পদ্ধতি আছে বলে অন্য লোকেরা রায় দিয়েছে।’
পেজ র্যাংকিং, এ্যালগরিদম - এক নতুন আইডিয়া
একে বলে পেজ র্যাংকিং এবং এটা ছিল একটা নতুন আইডিয়া। একাডেমিক নিবন্ধ যেভাবে অন্যরা পড়ে মূল্যায়ন করেন - তা থেকেই এর অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন পেজ আর ব্রিন। কারণ তারা তাদের বাবা-মায়ের কাজ থেকেই এটা জানতেন। আর এজন্য তারা ব্যবহার করেন জটিল এক ধরণের গণিত - যাকে বলা হয় এ্যালগরিদম।
‘কম্পিউটার কি কাজ করবে এবং কিভাবে কাজ করবে, তাকে তা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বলে দেয়ার একটা পদ্ধতি হচ্ছে এ্যালগরিদম। পেজর্যাংকের মূলে যে চমৎকার আইডিয়াটা কাজ করছে তা হলো, এ ক্ষেত্রে আপনি ওয়েবের গঠনটাকেই ব্যবহার করছেন। অর্থাৎ অন্য লোক যত বেশি আপনার পেজটির প্রতি আকৃষ্ট হবে ততই আপনার পেজটি শক্তিশালী, বিশ্বাসযোগ্য এবং প্রধান হয়ে উঠবে।’
‘অসংখ্য রকম নেটওয়ার্ক মিলে যে ইন্টারনেট - তাতে ঠিক কোন্ জিনিসটা গুরুত্বপূর্ণ - তা নির্ধারণের জন্য এখানে ব্যাকলিংক কাঠামোর সুবিধাটা নেয়া হচ্ছে। এর ওপর ভিত্তি করেই পেজর্যাংকিং এ্যালগরিদমটা কাজ করছে।’
এই এ্যালগরিদমটা ছিল ব্যাকরাব নামে একটা সার্চ ইঞ্জিনে, এটা পেজ ও ব্রিন চালু করেছিলেন ১৯৯৬ সালে। এটা যেভাবে কাজ করে তা দেখে তামারা খুবই মুগ্ধ হয়েছিলেন।
‘আমি বেশ আগে থেকেই ব্যাকরাব ব্যবহার করতে শুরু করেছিলাম। কারণ এটা ইন্টারনেট সার্চের জন্য খুব স্পষ্টভাবেই অন্যগুলোর চাইতে ভালো ছিল।’
ব্যাকরাব তখন এতই জনপ্রিয় হয়েছিল যে প্রায়ই চাপ সামলাতে না পেরে স্ট্যানফোর্ডের ইন্টারনেট ক্র্যাশ করতো । এসময়ই প্রতিষ্ঠাতারা ভাবলেন এটার একটা নতুন নাম দরকার।
বানানের ভুলে ‘গুগোল’ হয়ে গেল ‘গুগল’
সেজন্য নানা জনের আইডিয়া শোনার জন্য সবাই একটা ব্রেনস্টর্মিং সভায় বসলেন। সেই সভা এখন তথ্যপ্রযুক্তিযুগের কিংবদন্তীতে পরিণত হয়েছে।
সেখানেই গুগল নামটির প্রস্তাব করা হয়। স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সাদা বোর্ডে লেখা হলো সেই নাম। এটা গণিতশাস্ত্রের একটা শব্দ, কিন্তু সেটা লিখতে গিয়ে বানানো একটা ভুল হলো, হয়তো অনিচ্ছাকৃতভাবে, অথবা কে জানে, হয়তো ইচ্ছে করেই।
তামারা বলছিলেন, ‘এটা ছিল তাদের স্বভাবসুলভ দীর্ঘ একটা বৈঠক। আমি জানি, কারণ পরদিন এসে আমিও দেখলাম, সর্ব্নাশ, এরা তো বানানটা ভুল লিখেছে। কারণ আসলে শব্দটা হচ্ছে googol - ‘জি ডবল ও জি ও এল’ - যার মানে হচ্ছে একটা গাণিতিক সংখ্যা, দশের পিঠে একশটা শূন্য ‘জি ডবল ও জি এল ই’ নয়। কিন্তু সেটাই টিকে গেল।’
১৯৯৭ সালের ১৫ই সেপ্টেম্বর গুগল ডট কম ডোমেইন নামটি রেজিস্টার করা হলো।
আমরা নেই, ‘বার্নিং ম্যান’ দেখতে গেছি
তার কিছুদিন পরই বেরুলো প্রথম গুগল ডুডল - অর্থাৎ গুগল লোগোতে কোন বিশেষ ব্যক্তি, ঘটনা বা দিনকে স্মরণ করে যে পরিবর্তন আনা হয় । প্রথম ডুডলটিতে ছিল একটি জ্বলন্ত মানুষ, যার অর্থ পেজ ও ব্রিন নেভাদার ‘বার্নিং ম্যান’ উৎসবে বেড়াতে গেছেন।
‘গুগল এমন অনেক জিনিসই করেছে যা কর্পোরেট জগতে করা হয়নি। যেমন এই গুগল ডুডল। প্রথম ডুডলে ছিল গায়ে আগুন লাগা মানুষের ছবি - যার অর্থ সবাইকে জানিয়ে দেয়া যে তারা এখানে নেই, স্ট্যানফোর্ডের বাইরে কোথাও গেছেন।’
পরের বছর পেজ আর ব্রিন স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস ছেড়ে বাইরে বেরোলেন। তারা বন্ধু, পরিবার, আর কয়েকজন বিনিয়োগকারীর সাহায্য নিয়ে ১০ লাখ ডলার তুললেন, এবং চালু করলেন তাদের কোম্পানি। এর অফিস ছিল তাদের এক বন্ধুর গ্যারাজে।
সার্চ ইঞ্জিনটা ব্যবহার করা ছিল খুবই সহজ। আপনাকে শুধু তাদের ইন্টারফেসে একটা-দুটো শব্দ টাইপ করতে হতো। তাদের কোম্পানির আকার হুহু করে বাড়তে লাগলো।
‘তারা কতটা ভালো করছে তা বোঝা যেতো যখন তাদের কোন একটা পার্টিতে গিয়ে বলতে হতো ‘ও, তোমরা তো দেখছি অনেক বড় অফিস নিয়েছো। ‘আগেরবারের চেয়ে অনেক বেশি জায়গা নিয়ে তাদের পার্টি হচ্ছে।’
আগস্ট ২০০৪ সালে গুগল তাদের নতুন সদর দফতরে উঠলো। ক্যালিফোর্নিয়ায়। যার নাম গুগলপ্লেক্স। সেই একই বছর কোম্পানি স্টক মার্কেটে তালিকাভুক্ত হলো।
সেই ভুল বানানের ‘গুগল’ এখন একটি বিশেষ্য এবং ক্রিয়াপদ
গুগল এখন এমনভাবে আমাদের জীবনের অংশ হযে গেছে যে তা একটা বিশেষ্য এবং ক্রিয়াপদে পরিণত হয়েছে। তারা বিজ্ঞাপন থেকে শত শত কোটিডলার আয় করছে। তাদের বিরুদ্ধে ট্যাক্স ফাকি দেয়া, বাজারে একচেটিয়া প্রাধান্য কায়েম করা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে এবং চীনে তাদের বিরুদ্ধে সেন্সরশিপের অভিযোগও উঠেছে।
তামারা মাঞ্জনারকে প্রশ্ন করা হয়েছিল তার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের দুই বন্ধূ কি তাদের শুরুর সময়কার নীতিতে অটল থাকতে পেরেছে?
‘তাদের আদর্শ ছিল তারা যেন অশুভ কিছু হয়ে না ওঠে। তারা ঠিক সেটাই বিশ্বাস করতো। তারা পৃথিবীকে আরো বাসযোগ্য করার জন্য কাজ করেছে। আমি বুঝি যে এত বড় কোম্পানি হয়ে ওঠায় এখন তাদের হাতে বিপুল পরিমাণ ক্ষমতা এসে গেছে। কিন্তু প্রথম দিকে তারা এটাই চাইতো।’
তামারা এখন বিটিশ কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। তার কি এখন অনুতাপ হয় এই ভেবে যে কেন তিনি সে সময় গুগল এর সাথে জড়িত হননি, হয়তো তাহলে তিনি একজন বিলিওনিয়ার হয়ে যেতেন?
‘আমি ভেবেছিলাম কিন্তু কিভাবে আমি কাজ করতে চাই তা ঠিক করতে পারিনি। তা ছাড়া আমার চিন্তাভাবনাও তাদের চেয়ে আলাদা ছিল। আমার তখন মাথায় ছিল পিএইচডি শেষ করার চিন্তা। আমি ভেবেছিলাম না না কোন স্টার্ট-আপে যোগ দিলে আমার পিএইচডি আর শেষ করতে পারতাম না।’
সূত্র : বিবিসি