কাবুল বিমানবন্দর যেন শিমুলিয়া ঘাট
প্রকাশ : 2021-08-18 08:02:20১ | অনলাইন সংস্করণ
নিউজ ডেস্ক
করোনাকালের কঠোর লকডাউনের সময়কার একটি দৃশ্য এখনও নিশ্চয় সবার স্মৃতিতে জ্বলজ্বল করছে। ঈদ উপলক্ষে গ্রামে যাওয়ার উদ্দেশ্যে হাজার হাজার মানুষ ভিড় জমিয়েছিল মুৃন্সিগঞ্জের শিমুলিয়া ফেরিঘাটে। জীবন বাজী রেখে তাদের ফেরিতে চড়ার প্রতিযোগিতা সবাইকে হতবাক করে দিয়েছিল। কেউ পন্টুনের ডালার ওপর দিয়ে উঠছিল, কেউ নৌকা দিয়ে সরাসরি ফেরিতে ওঠার চেষ্টা করছিল। আরেক দল লোক নদীর পাড়ের সাথে পন্টুন বেঁধে রাখার কাছি বেয়ে সামরিক বাহিনীর কমান্ডো ট্রেনিংয়ের স্টাইলে ফেরিতে উঠার কসরৎ করছিল। ফেরিতে ছিল না তিল ধারণের জায়গা। অবস্থা দেখে মনে হয়েছে কেয়ামতের আগে বোধকরি এটাই শেষ ঈদ। তাই যেভাবেই হোক পদ্মা পাড়ি দিতে হবে। এই অবিবেচক মানুষগুলোর কারণে সে সময় দুর্ঘটনা ঘটেছে বেশ কয়েকটি, ঘটেছে প্রাণহানিও ।
ঠিক একই রকম দৃশ্য এবার দেখা গেল আফগানিস্তানের তালেবান বাহিনী দেশটির নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর রাজধানী কাবুলের বিমানবন্দরে। মার্কিন সেনা ও নাগরিকদের নিতে আসা ‘ক্যাম এয়ার’ ও মার্কিন বিমান বাহিনীর কার্গো বিমানে চড়তে পঙ্গপালের মতো ঝাঁপিয়ে পড়েছিল দেশত্যাগে প্রায় পাগল হয়ে ওঠা আফগান নাগরিকরা। টেলিভিশনে যারা সে দৃশ্য দেখেছেন তাদের নিশ্চয়ই করোনাকালে ঈদকে সামনে রেখে শিমুলিয়া ঘাটের দৃশ্য মনে পড়ে থাকবে। কোথায় চড়েনি আফগান নাগরিকরা? বিমানের ভেতরে, ককপিটে, ডানায়, চাকায়, লেজে, এমন কি ছাদেও চড়ে বসেছিল তারা। পাসপোর্ট-ভিসা ছাড়া এসব আফগান নাগরিকের ক’জন শেষ পর্যন্ত দেশ ছেড়ে পালাতে পেরেছে সে খবর অবশ্য এখনও পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। তবে সংবাদমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে, একটি বিমান উড্ডয়ন করলে ঝুলে থাকা দুই আফগান নাগরিক নিচে পড়ে মৃত্যুবরণ করেছে। এর আগে বিমানবন্দরে সমবেত হাজার হাজার আফগান নাগরিককে ছত্রভঙ্গ করতে মার্কিন বাহিনী গুলি ছুড়লে ৫/৭ জন নিহত হয়। আফগান নাগরিকদের এভাবে বিমানে চড়ে দেশত্যাগের ব্যর্থচেষ্টা নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। কেন তারা এভাবে দেশত্যাগ করতে চাইছে? তাহলে কি এরা নিরাপত্তাহীনতা বোধ করছে? যতদূর খবর পাওয়া গেছে, তালেবানরা রাজধানী কাবুল তাদের দখলে নিলেও এখনও পর্যন্ত ব্যাপক হারে কোনো জুলুম-নির্যাতন শুরু করেনি। যদিও রাজধানী কাবুলের অনেক স্থানে লুটতরাজের খবর দিয়েছে বার্ত সংস্থাগুলো। তবে, এটা ঠিক যে, দীর্ঘ তিন দশক দুই পরাশক্তির বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে আসা তালেবানদের মনে প্রচন্ড ক্ষোভ হয়তো রয়েছে। সে পুঞ্জিভূত ক্ষোভ যে কোনো মুহূর্তে বিষ্ফোরিত হয়ে একটি লঙ্কাকান্ড বাঁধিয়ে দিতে পারে। যারা এতকাল বিদেশি শক্তির তাবেদারি করেছে, মার্কিন ও ন্যাটো বাহিনীর দালালি করেছে, সঙ্গত কারণেই তারা তালেবানদের লক্ষ্যবস্তু হতে পারে। আর সে কারণেই মার্কিনীদের পুতুল সরকার প্রধান প্রেসিডেন্ট আশরাফ গানি দেশ ছেড়ে পালিয়েছে। এমন ভীতি অনেকেরই হয়তো আছে। এই ভীত-সন্ত্রস্ত মানুষগুলোই এখন কাবুল তথা আফগানিস্তান ছেড়ে পালাতে চাইছে। এ থেকে একটি বিষয় পরিস্কার যে, তালেবানরা আফগান নাগরিকদের এখনও আস্থায় নিতে পারেনি। আস্থার এই সঙ্কট দেশটির নীরিহ নাগরিকদের মনে জন্ম দিয়েছে জানমালের অনিশ্চয়তা। আর তা থেকেই দেশত্যাগের এই উন্মাদনা।
আফগানিস্তানে বিদেশি দখলদারিত্বের শুরু গত শতাব্দীর সত্তর দশকের একেবারে শেষ প্রান্তে। ১৯৭৮ সালে সম্পাদিত ২০ বছর মেয়াদি সোভিয়েত-আফগানিস্তান মৈত্রীচুক্তির বলে ১৯৭৯ সালের ২৪ ডিসেম্বর মধ্যরাতে সোভিয়েত বাহিনী আফগানিস্তানে তাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে। সেসময় ক্ষমতাসীন বিপ্লবী কাউন্সিলের চেয়ারম্যান হাফিজুল্লাহ অমিন নিহত হলে সোভিয়েত ইউনিয়ন তাদের তল্পিবাহক বাবরাক কারমালকে দেশটির ক্ষমতায় বসায়। দীর্ঘ এক দশকেরও বেশি সময় ধরে সোভিয়েট ইউনিয়ন আফগানিস্তানে তাদের দখলদারিত্ব বজায় রাখে। এরই মধ্যে আফগানিস্তানের মুজাহিদ বাহিনী প্রতিরোধ যুদ্ধ শুরু করে। জন্ম নেয় আল-কায়েদা বাহিনী। ওসামা বিন লাদেন আবির্ভূত হন মুজাদিদের নেতা হিসেবে। মুজাহিদ বাহনীর সাথে যুদ্ধের এক পর্যায়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন আন্তর্জাতিক চাপের মুখে পড়ে। বিজয়ের আশা নেই এবং প্রভূত অর্থ বিনাশের বিষয়টি উপলব্ধি করে লিওনিদ ব্রজনেভ পরবর্তী প্রেসিডেন্ট মিখাইল গর্বাচেভ ১৯৮৮ সালে আফগানিস্তান থেকে হাত গুটিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। কেননা, ততদিনে যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন ও সহযোগিতায় আফগান মুজাহিদরা সোভিয়েত বাহিনীকে প্রায় পর্যূদস্ত করে ফেলেছিল। ১৯৮৮ সালের ১৫ মে সোভিয়েত ইউনিয়ন আফগানিস্তান থেকে তাদের সৈন্য প্রত্যাহার শুরু করে এবং ১৯৮৯ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি তাদের শেষ সৈন্যটি আফগানিস্তান ত্যাগ করে। দীর্ঘ প্রায় এক দশকের যুদ্ধ সোভিয়েত ইউনিয়নকে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে। ৩০ হাজার সৈন্য নিয়ে দখলদারিত্ব শুরু করে সে সংখ্যা ১ লাখ ৮ হাজারে নিয়ে গেলেও দশ বছরে তারা হারিয়েছিল প্রায় ২০ হাজার সৈন্য।
আফগানিস্তানে মার্কিন আধিপত্য স্থায়ী রূপ নেয় মূলত ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কের টুইন টাওয়ারে আল-কায়েদার বিমান হামলার পর। ওই হামলার পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আল-কায়েদা নির্মলের অংশ হিসেবে আফগানিস্তান আক্রমণ করে। সোভিয়েত ইউনিয়ন বিদায় নেওয়ার পর দেশটি আফগান মুজাহিদদের দ্বারাই শাসিত হচ্ছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদ নিমূর্লের স্লোগানের আড়ালে আফগানিস্তানে দখলদারিত্ব সৃষ্টি করে। এর সাথে যুক্ত হয় ন্যাটো বাহিনী। দুই দশকের এই যুদ্ধে মারা গেছে হাজার হাজার আফগান নাগরিক। যুক্তরাষ্ট্র হারিয়েছে প্রায় আড়াই হাজার সৈন্য। আহত হয়েছে আরো কয়েক হাজার। ব্যয় হয়েছে প্রায় ৮৩ বিলিয়ন ডলার। নিজেদের দেশ থেকে বিদেশিদের বিতাড়িত করতে আফগানদের যেমন মূল্য দিতে হয়েছে, তেমনি একটি দেশকে পদানত করে রাখার উন্মত্ততার খেসারতও কম দেয়নি যুক্তরাষ্ট্র।
আফগানিস্তানের গত তিন দশকের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, দেশটি বিশ্বের দুই পরাশক্তির যুদ্ধের ময়দানে পরিণত হয়েছিল। সোভিয়েত বাহিনী চলে যাবার পর আফগানিস্তান মার্কিন আগ্রাসনের কবলে পড়লে তৈরি হয় তালেবান বাহিনী। তালেবানরা দেশটির প্রায় অর্ধেক অংশের নিয়ন্ত্রণ নিতে সক্ষম হয়। একটি দেশের দুই অংশ দুই ধরনের সরকার দ্বারা চালিত হতে থাকে। একদিকে তালেবান সরকার, অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট ও পশ্চিমা বিশ্বের সমর্থনপুষ্ট আফগান সরকার। রাজধানী কাবুলসহ দেশটির অর্ধেক অংশের নিয়ন্ত্রণ পেলেও তালেবানদের পরাস্ত করতে পারছিল না মার্কিন সাহায্যপুষ্ট আফগানবাহিনী। এ সময় মার্কিনীদের বোধোদয় ঘটে। সম্ভবত ভিয়েতনাম যুদ্ধের ফলাফলের তিক্ত অভিজ্ঞতা তাদের মনে পড়ে থাকবে। তাই নতুন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন চলতি বছরের জানুয়ারি মাসেই ঘোষণা দেন যে, যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তান থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করে নেবে। এরপরই দৃশ্যপট পাল্টে যেতে থাকে। একের পর গুরুত্বপূর্ণ শহর ও এলাকার নিয়ন্ত্রণ চলে যেতে থাকে তালেবানদের হাতে। অবশেষে ১৫ আগস্ট তালেবানরা রাজধানী কাবুলের নিয়ন্ত্রণ নিতে সক্ষম হয়।
এখন যে প্রশ্নটি বড় হয়ে দেখা দিয়েছে তাহলো, এরপর আফগানিস্তানের ভবিষ্যত কী? তালেবানরা কি দেশে একটি নাগরিকবান্ধব সরকার প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হবে? নাকি দেশটি আবারও গৃহযুদ্ধে জড়িয়ে পড়বে? বিষয়টি এখনও পরিস্কার নয় তালেবানরা কোন দিকে যাবে। ওরা কি যুদ্ধকালীন বিভেদ ভুলে বিরোধিতাকারীদের ক্ষমা করে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করবে, নাকি বিশ বছরের জুলুমের প্রতিশোধ নিতে খড়গহস্ত হয়ে উঠবে? এ নিবন্ধ লেখা পর্যন্ত (১৮ আগস্ট ২০২১) তালেবানদের নতুন সরকার গঠন সম্পর্কে কোনো স্পষ্ট তথ্য না পাওয়া গেলেও মোল্লা আবদুল গনি বারাদার প্রেসিডেন্ট হচ্ছেন বলে আভাস দিয়েছে বার্তা সংস্থাগুলো। তবে, যেভাবেই সরকার গঠিত হোক, তা যদি চলমান বিশ্ব ব্যবস্থার সাথে তাল মেলাতে না পারে, তাহলে এ বিজয় সংহত হওয়ার সম্ভাবনা কম। তাছাড়া বিশ্ব মোড়লরা আফগানিস্তান সম্পর্কে নতুন করে কী সিদ্ধান্ত নেবে তাও এখন পর্যন্ত স্পষ্ট নয়। যদিও আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিশ্লেষকরা বলছেন, তালেবানরা সরকার গঠন করলে চীন ও পাকিস্তান তাদেরকে সমর্থন করবে। ফলে বিশ্বের পরাশক্তিগুলোর পাঞ্জা লড়ার টেবিল হিসেবে ব্যবহৃত হওয়া থেকে সহসাই আফগানিস্তান মুক্ত হতে পারবে কি না তা এখনই বলা মুশকিল। রাজনীতি বিশ্লেষকরা মনে করেন, সবকিছু নির্ভর করছে তালেবানদের চিন্তাভাবনা ও পদক্ষেপের ওপর। তালেবানরা যদি ইসলামি হুকুমত কায়েমের নামে একচ্ছত্রাধিপত্য কায়েম করে, তাহলে দুদিন আগে-পরে আফগানিস্তানে পুনরায় রাজনৈতিক অস্থিরতা দেখা দিতে পারে। আর সে কারণেই তালেবানদের উদার গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার দিকেই যাওয়া উচিত বলে মনে করছেন অভিজ্ঞ মহল। অন্যথায় দেশটির ভবিষ্যত আবারো অনিশ্চয়তার গহ্বরে পতিত হতে পারে।
লেখক: সাংবাদিক ও রাজনীতি বিশ্লেষক।