করোনাকালেও সুন্দরবনে কমেনি অপরাধ
প্রকাশ : 2022-02-16 19:58:01১ | অনলাইন সংস্করণ
নিউজ ডেস্ক
বঙ্গোপসাগরের কোল ঘেঁষে গড়ে ওঠা সুন্দরবন বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এই লীলাভূমিতে বিচরণ করে প্রায় ৩৭৫ প্রজাতির বন্যপ্রাণী। প্রাকৃতিক দুর্যোগে এই বন দেয়াল হয়ে রক্ষা করে উপকূলবাসীদের। উপকূলের জনপদ নিরাপদে রাখলেও সুন্দরবন নিজেই ভুগছে অনিরাপত্তায়। জলবায়ু পরিবর্তন, পানির উচ্চতা বৃদ্ধি, পরিবেশ দূষণ, বন্যপ্রাণীর অবাধ শিকার ও কাঠ পাচারকারীদের কারণে প্রতিনিয়ত হুমকীর মুখে পড়ছে সুন্দরবন।
এদিকে বন বিভাগ বলছে, আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর স্মার্ট প্যাট্রোলিংসহ সুন্দরবনের প্রাণপ্রকৃতি রক্ষায় বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
বন বিভাগের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী দেড় যুগেরও কম সময়ের ব্যবধানে ৩২৬টি বাঘ কমেছে সুন্দরবনে। তবে বর্তমানে সুন্দরবনে বাঘের আনাগোনা বেড়েছে বলে জানান জেলে ও বাওয়ালিরা। হরিণ শিকারের বিষয়ে স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা যায়, সুন্দরবনে আবারও বেপরোয়া হয়ে উঠেছে হরিণ শিকারিরা। তারা বনের মধ্যে ফাঁদ পেতে ও গুলি করে চিত্রা ও মায়া হরিণ শিকার করছে। সংঘবদ্ধ চোরা শিকারিরা সুন্দরবনের গহীনে ফাঁদ পেতে হরিণ শিকার করে। পরে গোপন আস্তানায় মাংস ছাড়িয়ে সুন্দরবনসংলগ্ন বিভিন্ন এলাকায় বিক্রি করে। মোংলা, শরণখেলা, কয়রা, দাকোপ, পাইকগাছাসহ বনের আশপাশের এলাকায় সবচেয়ে বেশি হরিণের মাংস পাওয়া যায়। সর্বশেষ গত ৯ ফেব্রুয়ারি মোংলা উপজেলার ডাংমারি এলাকায় অভিযান চালিয়ে ৪২ কেজি হরিণের মাংস জব্দ করে কোস্টগার্ড পশ্চিম জোন, মোংলার সদস্যরা।
অপরদিকে সুন্দরবনের আশপাশের নদী-খালে বিষ দিয়ে মাছ শিকার বন্ধ করতে না পারায় সুন্দরবনের নদী-খাল ক্রমশ মাছ শূন্য হয়ে পড়ছে। বিষ দেওয়ার ফলে শুধু মাছ নয়, মারা যাচ্ছে অন্যান্য জলজ প্রাণী। এতে একদিকে বিরূপ প্রভাব পড়ছে বনজ সম্পদসহ পরিবেশের ওপর, অন্যদিকে স্বাস্থ্য ঝুঁকি বাড়ছে বাগেরহাটের উপকূলীয় অ লের বাসিন্দাদের। এ অবস্থায় জীববৈচিত্র্য ও প্রাকৃতিক সম্পদ সুরক্ষায় দ্রুত কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানান সংশ্লিষ্টরা।
সেভ দ্যা সুন্দরবন ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ড. শেখ ফরিদুল ইসলাম প্রতিবেদককে বলেন, সুন্দরবনের সৌন্দর্য হলো বন্যপ্রাণী। কঠোর আইন না থাকায় প্রচলিত আইনের ফাঁক-ফোকর দিয়ে বেরিয়ে অসাধু ব্যক্তিরা পুনরায় সুন্দরবনে বন্যপ্রাণী নিধনে লিপ্ত হয়।
বাঘ ও সুন্দরবনের বন্যপ্রাণী রক্ষায় সরকার সুন্দরবনের ৫২ শতাংশ বনভূমিকে অভয়াশ্রম ও সংরক্ষিত বনভূমি হিসেবে ঘোষণা করেছে। সংরক্ষিত বনা লের যে শর্ত, তা সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করতে পারলে বাঘের প্রজনন বাড়বে। প্রজনন বাড়লে বাঘ বাড়বে বলে জানান তিনি।
সুন্দরবন সুরক্ষা কমিটির আহ্বায়ক নজরুল ইসলাম আকন বলেন, প্রভাবশালী সিন্ডিকেটের ছত্রছায়ায় একশ্রেণির জেলে নৌকা ও ট্রলার নিয়ে বনের ভেতরে ঢুকে বিষ দিয়ে মাছ শিকার করছেন। এতে শুধু মাছ নয়, পানি বিষাক্ত হয়ে অন্যান্য জলজ প্রাণীও মারা যাচ্ছে। বিষ দিয়ে মাছ শিকার করায় সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এ নিয়ে আমরা অনেক সময় বিভিন্ন সভায় কথাও বলেছি। তারপরও অদৃশ্য কারণে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয় না। এছাড়া বাঘের ওপর যেসব হুমকি আছে, তা বন্ধ করতে হবে।
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান অনুষদের অধ্যাপক ড. আবদুল্লাহ হারুন চৌধুরী বলেন, সুন্দরবনের জন্য এখন সবচেয়ে বড় হুমকি পানি ও মাটির লবণাক্ততা বৃদ্ধি। এর ফলে অপেক্ষাকৃত কম লবণসহিষ্ণু গাছের সংখ্যা কমছে, অন্যদিকে বেশি লবণসহিষ্ণু গরান, গেওয়া, কেওড়া, বাইন গাছ, কালিয়ালতা, গিলালতাসহ লতাগুল্ম বাড়ছে। এ অবস্থায় সুন্দরবনের পুরোনো জীববৈচিত্র্যে পরিবর্তন ঘটছে।
কোস্টগার্ড পশ্চিম জোনের জোনাল কমান্ডার ক্যাপ্টেন মোসায়েদ হোসাইন বলেন, সুন্দরবনে যে কোনো অপরাধ দমনে কোস্টগার্ড প্রস্তুত থাকে। বন বিভাগকে আমরা সব ধরনের সহযোগিতা করি। এ ছাড়া সুন্দরবনের বিভিন্ন স্থানে আমরা বনায়ন করেছি। প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষায় বনের সাথে জড়িত সকলকে সচেতন হওয়ার অনুরোধ জানান তিনি।
পূর্ব সুন্দরবনের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) মুহাম্মদ বেলায়েত হোসেন এই প্রতিবেদককে বলেন, সুন্দরবন সুরক্ষা করতে বন সংলগ্ন এলাকার মানুষদের আমরা বিভিন্নভাবে সচেতন করছি। যাতে সুন্দরবনের উপরে কোনো বিরূপ প্রভাব না পড়ে। এছাড়া বনের মধ্যে যে কোনো অপরাধ আমরা কঠোরভাবে দমন করি। সুন্দরবনের অর্ধেকেরও বেশি এলাকা সংরক্ষিত বন হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগে বাঘ সেখানে আশ্রয় নিতে পারে। চোরা শিকারিদের তৎপরতা বন্ধে স্মার্ট পেট্রোলিংও চালু রয়েছে।