একজন পুরুষ যখন নিজের স্ত্রীসহ সমসাময়িক নারী জাগরণের অগ্রদূত
প্রকাশ : 2023-06-01 14:42:18১ | অনলাইন সংস্করণ
নিউজ ডেস্ক
সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন বাঙালি লেখক, সংগীতস্রষ্টা ও ভাষাবিদ। তিনি ছিলেন ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিসে যোগদানকারী প্রথম ভারতীয়। ব্রিটিশ ভারতের নারীমুক্তি আন্দোলনে সত্যেন্দ্রনাথ উল্লেখযোগ্য ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। পারিবারিক পরিচয়ে তিনি ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অগ্রজ।
রামমোহন রায় দেখেছিলেন সেযুগের হিন্দু নারীরা ছিলেন অশিক্ষিত ও নিরক্ষর; তারা সম্পত্তির অধিকার থেকে বঞ্চিতা হতেন, বাল্যকালেই তাদের বিবাহ হয়ে যেত, তারপর সারা জীবন পর্দার আড়ালে কাটাতেন এবং স্বামীর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই সতী করার নামে তাদের নৃশংসভাবে হত্যা করা হত। সতীদাহ প্রথা ১৮২৯ সালে অর্থাৎ সত্যেন্দ্রনাথের জন্মের বহু আগেই আইন দ্বারা নিষিদ্ধ হয়েছিল এবং মেয়েদের সামাজিক অধিকার প্রদানের প্রক্রিয়াগুলিও শুরু হয়ে গিয়েছিল।
তা সত্ত্বেও হিন্দু সমাজে নারীর অবমাননাকর অবস্থান ছেলেবেলা থেকেই সত্যেন্দ্রনাথকে ভাবিয়ে তুলেছিল। তিনি মনে করতেন, তার পরিবারে প্রচলিত পর্দা প্রথা হিন্দু সংস্কৃতির অঙ্গ নয়, বরং তা মুসলমান সমাজে প্রচলিত প্রথার অনুকরণ মাত্র। ইংল্যান্ডের সমাজে তিনি নারীর যে উচ্চ স্থান দেখেছিলেন, তা ভারতীয় সমাজে নারীর তুলনামূলকভাবে অসম্মানজনক অবস্থানটি তার কাছে স্পষ্ট করে দিয়েছিল।
বিবাহের পর সত্যেন্দ্রনাথ দেখলেন, জ্ঞানদানন্দিনী দেবী তার আদর্শ জীবনসঙ্গিনী। ইংল্যান্ডের সমাজে সত্যেন্দ্রনাথ যে নারী স্বাধীনতা প্রত্যক্ষ করেছিলেন, তা তিনি জ্ঞানদানন্দিনীকেও দেখাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাধায় সেবার জ্ঞানদানন্দিনীর ইংল্যান্ড যাওয়া হয়নি।
দেশে ফেরার পর অবশ্য সত্যেন্দ্রনাথ জ্ঞানদানন্দিনীকে বোম্বাই নিয়ে যান। ইংরেজ আইসিএস অফিসারদের স্ত্রীরা যে আদবকায়দায় চলতেন, তা বোম্বাইতে গিয়ে রপ্ত করে নেন জ্ঞানদানন্দিনী। অবকাশের সময় সস্ত্রীক সত্যেন্দ্রনাথ জোড়াসাঁকোর বাড়িতে ফিরলে, কলকাতার সমাজে আলোড়ন সৃষ্টি হয়। এই সময়, লাটভবনে (অধুনা রাজভবন) একটি ভোজসভায় নিমন্ত্রিত সব সামাজিক প্রথা লঙ্ঘন করে স্বামীর সঙ্গে সেই ভোজসভায় যান জ্ঞানদানন্দিনী। সেখানে ইংরেজ রমণীদের মাঝে তিনি ছিলেন একমাত্র বাঙালি রমণী। ঠাকুর পরিবারের পাথুরিয়াঘাটা শাখার প্রসন্নকুমার ঠাকুর এই ভোজসভায় উপস্থিত ছিলেন। তিনি পরিবারের এক গৃহবধূকে ওইরকম প্রকাশ্য স্থানে দেখে লজ্জায় ও ক্ষোভে তৎক্ষণাৎ সভাস্থল ত্যাগ করে চলে যান।
১৮৭৭ সালে সত্যেন্দ্রনাথ জ্ঞানদানন্দিনীকে এক ইংরেজ দম্পতির সঙ্গে ইংল্যান্ডে প্রেরণ করেন। জ্ঞানদানন্দিনী যে স্বামীকে ছাড়াই তার তিন সন্তানকে নিয়ে ইংল্যান্ড পাড়ি দিয়েছিলেন, তা সেকালে ছিল এক দুঃসাহসী কাজ। প্রথম দিকে তারা তাদের জ্ঞাতি প্রসন্নকুমার ঠাকুরের পুত্র জ্ঞানেন্দ্রমোহন ঠাকুরের বাড়িতে ওঠেন। উল্লেখ্য, জ্ঞানেন্দ্রমোহনই ছিলেন প্রথম ভারতীয় যিনি ইংল্যান্ডের বারে সাফল্য অর্জন করেন। ইনি খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। পরে জ্ঞানদানন্দিনী ব্রাইটনে চলে আসেন এবং সন্তানদের নিয়ে সেখানে পৃথকভাবে থাকতে শুরু করেন।
এরপর সত্যেন্দ্রনাথ রবীন্দ্রনাথকেও ইংল্যান্ডে নিয়ে আসেন। রবীন্দ্রনাথের সেই ছিল প্রথম ইংল্যান্ড ভ্রমণ। ১৮৮০ সালে সকলে ভারতে ফিরে আসেন। শুধুমাত্র জ্ঞানদানন্দিনীই নন, সত্যেন্দ্রনাথের বোনেরাও সামাজিক পরিবর্তনে অংশ নিয়েছিলেন। তার বোন সৌদামিনী দেবী লিখেছেন যে, পথেঘাটে তাদের যে বিদ্রুপ সহ্য করতে হত, তা আজকের যুগে অবিশ্বাস্য শোনায়।
এজন্য উচ্চ ও মধ্যবিত্ত বাঙালি হিন্দু সমাজের মেয়েদের পর্দাপ্রথার বাইরে বের করে আনার কৃতিত্ব অনেকটাই পেয়ে থাকেন সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর।
জ্ঞানদানন্দিনী দেবী সমাজ সংস্কারে নিজস্ব কিছু অবদান রেখেছিলেন। তিনি শাড়ি পরার যে নতুন পদ্ধতি আবিষ্কার করেন, তা আজকের ভারতীয় সমাজে ব্যাপকভাবে অনুসৃত হয়। এছাড়া যথাযথ অন্তর্বাস ব্যবহার করার প্রথাও তিনি চালু করেন।
শিশুদের বিকাশের দিকেও জ্ঞানদানন্দিনী বিশেষ নজর রাখতেন। তিনি পরিবারে ছেলেমেয়েদের জন্মদিন পালনের প্রথা চালু করেন। এই উপলক্ষে তাদের উপহার দিয়ে দিনটি বিশেষভাবে উদ্যাপন করা হত। ১৮৮৫ সালে তিনি বালক নামে একটি শিশুপাঠ্য পত্রিকা চালু করেন। এটিই সম্ভবত বাংলা ভাষায় প্রথম শিশুপাঠ্য পত্রিকা। এই পত্রিকাটিই রবীন্দ্রনাথকে ছোটোদের জন্য লেখালিখিতে উৎসাহিত করে তুলেছিল। রাজর্ষি সহ তার একাধিক উল্লেখযোগ্য রচনা এই পত্রিকাতেই প্রকাশিত হয়েছিল। একবছর চলার পর পত্রিকাটি ঠাকুর পরিবারের পারিবারিক পত্রিকা ভারতী-র সঙ্গে একীভূত হয়ে যায়।