ইতিহাসের পাতায় দুর্গাপূজা
প্রকাশ : 2021-10-12 10:12:15১ | অনলাইন সংস্করণ
নিউজ ডেস্ক
শাশ্বত স্বপন
-------------
২য় পর্ব:
মূল বাল্মীকির রামায়ণে, দুর্গাপূজার কোন অস্থিত্বই নাই। কিন্তু কৃত্তিবাসী রামায়নে দুর্গাপুজার অস্থিত্ব আছে। কৃত্তিবাসী রামায়ণ-এর প্রধান বৈশিষ্ট্য হল, এটি মূল রামায়ণের আক্ষরিক অনুবাদ নয়। মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শক্তিশালী কবি কৃত্তিবাস ওঝা সংস্কৃত রামায়ণ বাংলা করার সময় মূল রামায়ণের বাইরের তৎলালীন সমাজে প্রচলিত বাংলার সামাজিক রীতিনীতি ও লৌকিক জীবনের নানা অনুষঙ্গ, অনেক মিথ, গল্প বাংলা রামায়ণে সংযোগ করে বাংলা রামায়ণ আরো অধিক সমৃদ্ধ করার চেষ্টা করেন। অন্যভাবে বলা যেতে পারে, তিনি সংস্কৃত রামায়ণ উপাখ্যানের এমনভাবে বঙ্গীকরণ বা বাংগালীকরন করেন, যা পড়লে মনে হবে, রামায়নের ঘটনা তার সমাজের আদি কাহিনী।
তাঁর এই অনুবাদকৃত রামায়ণ পরিচিত পায় কৃত্তিবাসী রামায়ণ নামে--যা বাংলাভাষী হিন্দু সমাজে বেশ জনপ্রিয়তা পায়, সেখানে তিনি কালিকা পুরাণের ঘটনা অনুসরণে ব্রহ্মার পরামর্শে রামের দূর্গা পূজা করার কথা উল্লেখ করেছেন। শক্তিশালী রাবণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ বিজয় নিশ্চিত করতে শরৎকালে শ্রী রামচন্দ্র কালিদহ সাগর থেকে ১০১ টি নীল পদ্ম সংগ্রহ করে প্রাক্ প্রস্তুতি হিসাবে দুর্গাপূজা করে দুর্গার কৃপা লাভ করেন বলে কৃত্তিবাস ওঝা বর্ণনা করেছেন। তবে দুর্গা পূজার সব চাইতে বিশদ বর্ণনা পাওয়া যায় মার্কন্ডুয়ে পুরানে। যেখানে মহির্ষী জৈমিনি ও মহির্ষী মার্কন্ডুয়ের কথোপকথনের ভিত্তিতে পুরাণটি রচিত হয়। এই পুরাণের মধ্যে তেরটি অধ্যায় দেবীমহাত্মম নামে পরিচিত। বাংলায় শ্রীশ্রীচন্ডি নামে সাতশত শ্লোক বিশিষ্ট দেবী মহাত্মম পাঠ আছে--যা দুর্গা পূজার প্রধান ও অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে পূজার আসরে স্থায়ী হয়ে গেছে।
নিচের ছবিতে সঙ্গী একজন বাচ্চা দেখা যাচ্ছে। ছাঁচটা অবতল হলেও উত্তলও মনে হয়। এঁকে যক্ষী বা পঞ্চচূড়া অপ্সরা বলেন কেউ কেউ, যদিও উপাস্য মাতৃকা বলে স্বীকার করেছেন অনেকে। গবেষক তমাল দাসগুপ্ত একে মা দশায়ুধা বলেন। হতে পারে, এই মাতৃকা রূপই দেবী দুর্গার আদি রূপ।
সনাতন ধর্মের আর্য ঋষিরা সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের প্রতীক হিসাবে দেবী দুর্গার আশীর্বাদ লাভের জন্য আরাধনা করতেন। মার্কন্ডুয়ে পুরান (Markandeya Purana ) মতে, চেদী রাজবংশের রাজা সুরাথা(Suratha) খ্রীষ্ঠের জন্মের ৩০০ বছর আগে কলিঙ্গে (বর্তমানে ওড়িষ্যা) Duseehera নামে দুর্গাপূজা প্রচলন করেছিল এবং রাজা সুরাথা মহাষ্টমীর সন্ধিপূজার পর পাঠা বলির প্রথা চালু করেন। নেপালে Duseehera বা Dashain নামেই পুজা হয়। যদিও প্রাচীন ওরিষ্যার সাথে নেপালের পূজার যোগসূত্র আছে কিনা সে তথ্য সংগ্রহ করা সম্ভব হয়নি।
ভারত বর্ষের ইতিহাসে মহারাষ্ট্র, অন্ধ্রপ্রদেশ ও তার সংলগ্ন কিছৃ এলাকাকে দাক্ষিণাত্য বলে ধরা হয়ে থাকে। মৌর্য পরবর্তী যুগে এই এলাকায় সর্বপ্রথম ও সর্ববৃহৎ রাজবংশ সাতবাহনদের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, সেই সাথে সমসাময়িক কলিঙ্গে চেদী বংশের খ্যাতিও শুনা যায়। এই চেদী বংশের এক রাজা নাম সুরথ(sutratha)। প্রচলিত মিথ যে, এই রাজা সুরথ প্রথম দুর্গাপূজা শুরু করেছিলেন।
পরিব্রাজক, বৌদ্ধ পন্ডিত হিউয়েন সাংকে নিয়ে দুর্গাপূজার একটি কাহিনী প্রচলিত আছে। চীনা ভাষায় রচিত বৌদ্ধ ধর্মের ব্যাখায় বিভ্রান্ত হয়ে তিনি বৌদ্ধধর্মের মূল পান্ডুলিপি সংগ্রহে আনুমানিক ৬৩০ সালে ভারত সফরে আসেন। ভারত বর্ষের নানা বিহারে বিদ্যা অর্জন করেন। ৬৩৫-৬৪৩ পর্যন্ত দীর্ঘ আট বছর তিনি হর্ষবর্ধনের রাজ সভায় ছিলেন। তবে তার কাহিনী দুর্গা, কালী, কালীর আরেক রূপ চন্ডি নাকি অন্য কোনো বন দেবীকে নিয়ে-তা নিয়ে মতবেধ আছে। তবে তার রচনায় উল্লেখ করেছেন, হর্ষবর্ধন এর সময়ে দস্যু তস্কর এর উপদ্রব খুব বেশি ছিল এবং তিনি নিজেও একাধিক বার দস্যুর হাতে নিগৃহিত হয়েছিলেন। তার প্রবাস জীবনের কোন এক সময়ে গঙ্গাপথে (প্রাচীন গঙ্গারিডি) এই পরিব্রাজক কোন বৌদ্ধ বিহারে যাচ্ছিলেন। পথে দস্যুর কবলে পড়লেন। দস্যুরা তাকে দেবী দূর্গার সামনে বলি দেওয়ার জন্য নিয়ে যাচ্ছে। কেউ মনে করেন, বন দেবী, কেউ মনে করেন কালী, কারণ প্রাচীনকালে নরমুন্ড ভোগ দেবার বিষয়টি বনদেবীদের বা কালী দেবীর জন্য প্রযোজ্য ছিল--যা এখন পাঠা দিয়ে পূরণ করা হয়। দুর্গা মাকে খুশী করার জন্য নরমুণ্ড ভোগ দেবার বিষয়টি ইতিহাস থেকে জানা যায় না। যাই হোক, বলির পূর্ব প্রস্ততি প্রায় শেষ, এমন সময় প্রচন্ড বেগে ঝড় ছুটে এল। সব আয়োজন ঝড়ের কবলে লন্ডবন্ড হয়ে গেল। ডাকাতরা জান বাঁচাতে পালাতে লাগল। সেই সুযোগে হিউয়েন সাংও পালিয়ে যান।
অষ্টম শতাব্দিতে রাস্ট্রকূট রাজাদের আমলে কর্ণাটকে প্রকৃতিমাতা বন সংকরী দেবীর পূজা হতো। সময়টা ধরা হয়ে থাকে যে, এ মন্দির অষ্টম শতাব্দির বা তারও আগের। বর্তমানে ভক্তরা বন সংকরী দেবীকে দূর্গা, সরস্বতী ও লক্ষীর মিলিত রূপ মনে করে। এই মন্দিরের উল্টোদিকে শাকম্ভরী নামে একটা দিঘী আছে। আবার শাকম্ভরী দুর্গার আরেক নাম।
ভারতের পূর্বপ্রান্তে পশ্চিম বঙ্গের বাঁকুড়া জেলার বনবিষ্ণুপুরে (বর্তমানে বিষ্ণুপুর)মল্ল রাজবাড়ির অবস্থান। দশম শতাব্দির শেষদিকে মল্লরাজ জগৎমল্ল তাঁদের কুলদেবী মৃন্ময়ীর স্বপ্নাদেশ পেয়ে মন্দির তৈরি করেন। এখন বিষ্ণুপুর পৌরসভা এই পূজার দায়িত্ব পালন করেন। এই বিষ্ণুপুরই পশ্চিমবঙ্গের প্রাচীনতম দুর্গাপুজার স্থান। অনেকে মনে করেন, তখন সপরিবারে দুর্গাপুজা শুরু হয়নি, হয়েছে মৃন্ময়ী দেবীর নামে যা দুর্গার আরেক নাম।
দ্বাদশ শতাব্দির প্রথম ভাগে রচিত রাজা রামপালের রাজকবি সন্ধাকর নন্দি রচিত রামচরিত কাব্য থেকে জানা যায়, উত্তরবঙ্গের বরেন্দ্রভুমিতে(প্রাচীন কট্রলী) বিশাল আয়োজনে উমাপূজা হত (দুর্গার আরেক নাম)। প্রায় একই সময়ে বাঙ্গালী পণ্ডিত শূলপাণি রচনা করছেন, দুর্গোসব, বাসন্তি বিবেক, দুর্গোৎসব প্রয়োগ--নামে তিনটি লেখা। তিনি লেখার তথ্যগুলো সংগ্রহ করেছিলেন প্রাচীন স্মার্ত পণ্ডিত জীকন ও বালকের লেখা থেকে। শূলপাণির সমসাময়িক জীমূতবাহন দুর্গোসব নির্ণয় নামে গ্রন্থে মাটির প্রতিমার দুর্গাপুজার বিষয়ে উল্লেখ করেছেন। প্রাচীনকালে শুধু খড় মাটি নয়, কাঠ, ধাতু বা পাথরের প্রতিমাতেও দুর্গাপূজা হত এবং এখনো পশ্চিম বঙ্গের কিছু জায়গায় তা হয়। লেখক অর্ণব বলেন, বৌদ্ধ পাল রাজাদের রাজত্বকালের শেষভাগে বাংলার দুর্গাপুজা উৎসবে পরিণত হয়। লেখক অর্ণবের সাথে গবেষক তমাল দাসগুপ্ত একমত পোষণ করেন না। তমাল দাসগুপ্ত মনে করেন, সেন আমলে দেবী গৌণ করে দেবতাদের মূখ্য করা হয়েছে।
লেখক অর্ণব বলেন, চৈতন্যপার্ষদ নিত্যানন্দ প্রভুও (১৪৭৪-১৫৩২) অধুনা উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলার খড়দহে স্বগৃহে প্রতিমায় দুর্গোৎসব করতেন। তাঁর বংশধরেরা আজও বেঁচে আছেন এবং তাঁরাও সেই দুর্গোৎসবের ধারা বজায় রেখেছেন। মনে রাখা দরকার, দুর্গাপূজা সাধারণত জাঁকজমকের সঙ্গে পালিত হলেও, দুর্গাপূজার প্রাচীন বিধানগুলিতে সাধারণ পঞ্চোপচারে এবং তার অভাবে শুধুমাত্র গঙ্গাজলে দুর্গাপূজারও বিধান পাওয়া যায়। দার্জিলিং জেলার একটি বৌদ্ধ পরিবারে এমন এক সরল দুর্গাপূজা দেখার সৌভাগ্য অর্জন করেছিলাম।’