আমার স্কুল বেলা

প্রকাশ : 2022-11-23 09:46:54১ |  অনলাইন সংস্করণ

  নিউজ ডেস্ক   

আমার স্কুল বেলা

ডা. মনোজ কুমার বড়ুয়া 
--------------------------


শীতের আগমনি বার্তা বইছে প্রকৃতিতে। বিকেল থেকেই কেমন একটা হিম হিম ভাব। একরত্তি সাদা মেঘভেলা নেই নীল আকাশে।  সেগুনের পাহাড়টা কেমন ফেকাসে সবুজ। উদাসী কাকের ডাক ছাড়া আর কোন শব্দ নাই। 

পাশের ফ্লাটের বাচ্চা বউটা আরিয়ান আরিয়ান করে তার ৪ বছরের ছেলের নাম ধরে ডাকছে,  কি মায়া সেই ডাকে ! হয়তো কপালে কাজলের টিপ দিচ্ছে । এইতো আর কিছুদিন পর-ই সাজু গুজু করে স্কুলে পাঠাবে। কতো স্বপ্ন !  আমাদের নিয়েও আমাদের বাবা-মায়ের কত স্বপ্ন, কত আনন্দ আর কত গল্প ছিলো  !! 

উদাসী হাওয়ায় উদাসী আমার মন।  বয়সের এই বেলায় এসে বেশি মনে পড়ে ছোট্টোবেলার কথা, স্কুল দিনের কথা, পাড়ার কথা । 

সাদা সার্ট সাদা পেন্ট বা আকাশী-নীল সার্ট আর খাকি রঙের পেন্ট পরা একদল ছেলেমেয়ে সকালে দল বেঁধে স্কুলে যাই। সারা রাস্তা কলকাকলীতে উচ্ছ্বল। ক্লাস'মেট  দূজা , টিপু , বিজু, পান্না, আজাদ , মিল্টন , শফিক , আশরাফ , বাচ্চু , আযম , রসুল , মোতাহার , মানিক , সদরুল , তানভির , মিজান , পারভেজ এর সাথে সারাদিন কতো খুনসুটি !! 
বিকেলে আবার উল্টা !  

সারাদিনের ধকলে ড্রেস মলিন,  মন আরো মলিন।  সারাটা রাস্তা চুপচাপ কোন একটা কিছুকে কিক দিতে দিতে স্কুল থেকে প্রায়  বাসায় নিয়ে আসতাম। মাঝে মাঝে রাস্তায় পরে থাকা তাস ( সিগারেটের প্যাকেট) বা রঙ চঙে কিছু নজরে আসলেই তা' কুড়িয়ে নেওয়া । 
একবার উপল দুই মোরগের লড়াই দেখতে দেখতে ,  আরেকবার  নিয়ন আর ক্রেয়ন বানরের লাঠিখেলা দেখতে দেখতে  বাসার কথাই ভুলে গিয়েছিল।  বাসায় ফিরেই মা'য়ের আদরে আবার চাঙা !  খেয়েই দৌড়ে মাঠে।  
  
স্কুল ছিলো ১০:৩০ টা থেকে ৩:৩০ টা পর্যন্ত । 
তাই টিফিন পিরিওডে স্কুলের টিফিনের সাথে আরো কিছু খেতাম।  আমার মা পেঁয়াজ হলুদ মরিচ ডিম আর ভাত দিয়ে বিশেষ ধরনের টিফিন বানাতেন।  সেটার নাম ফ্রাইড রাইস । আসলে ওটা  ভাত-ভাঁজি। আমার মনে হয় তখনকার  সব মায়েরাই এটা বানাতে পারত। প্রতিদিনই  স্কুলে আমার টিফিন হিসেবে থাকত এই হলদেটে রঙের  ভাতভাজি। 

এখানে বলে রাখি, স্কুল কর্তৃপক্ষ খুবই ভাল টিফিন দিতো। কলা আর ব্রেড - বিখ্যাত মডার্ণ ব্রেড অথবা  নিমকি আর মিষ্টি, পরটা আর হালুয়া, সিঙ্গারা,  গজা ( এক জীবনে এতো গজা খেয়েছি যে এখন গজা দেখলে উল্টি আসে)। 

কিন্তু মন বেশি টানতো গেটের বাহিরে পসরা সাজিয়ে বসা চটপটি ( আট আনা, স্পেশাল ১ টাকা), ফুচকা, লাল টুকটুকে গোল্লাবরফ ( আট আনা) , মালাইকোন ( কোন-আইসক্রিমের অতি ক্ষুদ্র বাংলা সংস্করণ)  বেতফলের থোকা , গাব, পানিফল,  কাঠিওয়ালা কৎবেল , হলুদ ভিজা চটচটে  চালতা আঁচার,  সাদা-কালো রঙের  নিমক-সোলেমানি [হজমি - বিশ পয়সা )  ।  আর স্কুলের দপ্তরি  অমূল্য কাকুর বানানো কাবলী বা চনা বিরানি ( পেঁয়াজ বেরেস্তা ডাবলি মটর আর কিউব করে কাটা আলুর মিক্সচার ) ইত্যাদির দিকে। 
এছারাও শর্মা'দের বেকারির প্যাটিস ( দেড় টাকা)  বা স্কুলের  পাশের  টিপু'দের পাড়ার বিস্কুট ফেক্টরির ক্রিম রোল [ ১ টাকা),  বাটার বন, মুড়ি বিস্কুট !   

কতো আর ভাত ভাজি!  
মা'কে খাবোনা  বলবো - তখনো অতো বড় হই নাই। তাই মা'কে বানিয়ে বল্লাম - 
মা স্কুলে এই ভাতের খাবার  নিয়ে যেতে নিষেধ করেছে ,  তাতে স্কুল নাকি নোংরা হয়। 
পরের দিন যথারীতি  মা স্কুলে এসে হাজির।

আমাকে ডাকা হলো হেড মাস্টারের রুমে। এখানে একটু স্যারের  বর্ণনা দেই।
তখনকার বাংলাদেশের বিখ্যাত শ্রদ্ধেয় নূর মোহাম্মদ স্যার। আমাদের  তেজগাঁও গভর্নমেন্ট হাইস্কুল  তখন মাঝখানে একটা দেওয়াল দিয়ে বয়েজ ও গার্লস দুই অংশে বিভক্ত।  বিশাল বিশাল দুই স্কুলের সব ছাত্র ছাত্রী ও শিক্ষকবৃন্দ ছোটখাটো এই মানুষটার ভয়ে এক ঘাটে পানি খেতাম। সারা বাংলার সব সরকারি বেসরকারি সকল ধরনের প্রতিষ্ঠানে রোববার সাপ্তাহিক ছুটি।  শুধুমাত্র আমাদের স্কুল শুক্রবার ছুটি, কারণ হলো স্যার এর ইচ্ছা। 

যাচ্ছি স্যারের রুমে। সুরা মন্ত্র যে কটা জানা আছে  সব পড়ে বুকে ফু দেওয়া  শেষ। 
মানত সাধ্যির মধ্যে যা যা করতে পারার সব করা হয়ে গেছে।  তো ঢুকলাম হেডস্যার এর রুমে।  স্যার স্যারের চেয়ারে..,। আর তাঁর সামনের চেয়ারে মা বসা ... 
আর তাদের দুইজনের মাঝের টেবিলের উপর -
দুইপাশে কালো রাবারের  আংটা লাগানো সিলভারের টিফিন বক্স , ভিতরে  সেই মহার্ঘ  হলুদ ভাত-ভাজি !  

স্যার আমার হাতে বেতের একটা বাড়ি দিয়ে  বলল [ফার্মগেটের ওভারব্রীজের সেই জালিবেত , তখন চন্দ্রার পিকনিক থেকে ফিরার সময় সবাই এই বেত একটা করে নিয়ে আসতো !] 

- কি ? বিজ্ঞানী হইয়া গেছো ? 
নিজে নিজে সূত্র বানাও ? 

মারটা আমি খেলেও সেদিন আসল কষ্টটা পেয়েছিল আমার মা। এর পর থেকে ভাত-ভাজি দেয়া Stop. রুটি ভাঁজি দিতো, রুটিতে জেলি লাগিয়ে দিত [মা'র নিজের হাতে নিজের গাছের পেয়ারা দিয়ে বানানো জেলি] , পরটা হালুয়া দিতো। 
বাট নো মোড় ভাত ভাজি । 

স্কুল শেষ হলো...  কলেজও , ডাক্তার হয়ে সরকারি চাকরি নিয়ে চাঁটগা চলে আসলাম । 
কিন্তু আর ভাত ভাজি খাইনি ! দীর্ঘ ২০ বছর পরে  আমার জীবনের ভাত-ভাজির অধ্যায় আবার শুরু হলো, যখন আমি  আবার ঢাকার BSMMU তে পড়তে আসলাম  MS কোর্সে।  

শাহবাগের BSMMU তে প্রতিদিন সকাল থেকে প্রথমে patient নিয়ে Planning, এরপর OT , তারপর patient management, অতঃপর একটানা সন্ধ্যা পর্যন্ত PG র পাঁচ তলার লাইব্রেরীতে পড়ে আবার একটু ওয়ার্ড রাউন্ড দিয়ে, শরীরের হাড়-মাংস এক করে যখন বাসায় ফিরতাম - একাকী ঘরে। তখন মনে পরতো মা'র ভাত ভাঁজির কথা । 

মা'য়ের মায়া ঝরা চেহারাটা মনে পড়ে। কাঁদতে কাঁদতে ভাত ভাজি করতাম । 
লবন দিতে হতো না , চোখের পানিতেই হয়ে যেত । মা যখন ফোন করে তখন গলায় একটা খুশি খুশি ভাব নিয়ে বলি -  মজা করে খাচ্ছি । কিন্তু গলার ভাঙ্গা ফেঁস ফেঁসে ভাব ঠিকই মা বুঝে ফেলেছে! তারপর দিন BSMMU থেকে ফিরে ঘর খুলেই দেখি এক ডেকচি রান্নাকরা আমার প্রিয় মাংস , বাবা নিয়ে এসেছে! 
বাবা আমার বাবা ।  আমার এলোমেলো ঘরের সমস্ত জিনিস গুছিয়েছে।  সকালে হুরাহুরি করে বের হওয়ায় রেখে যাওয়া কাপ ডিশ সব ধুয়েমুছে গেছে।  
বাবা আমার বাবা।  আমার চোখ ঝাপসা হয়ে আসে।  একটা সময় ছিলো পেটিস,  চকলেট বা চুইংগাম কেনার জন্য বায়না ধরতে হতো । আর এখন আমি  রাত জেগে পড়ি বলে আমার প্রিয় কফি ,  চানাচুর , বাদাম ,  বিস্কুটের প্যাকেটটা বাবা নিয়ে এসেছে। প্রয়োজনটা ঠিকই বুঝে ফেলেছে বাবা । অনেক হিসাব করে চলা আমার বাবা আমার বেলায় বেহিসেবী হয়ে যায় ।  দেখে আমার চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। ডুকরে কেঁদে উঠি । 

মাংস দেখে আমি খুশি হবো কি, আমার দুই চোখ বেয়ে ঝরঝর করে কান্না ঝরছে। 
মা ফোন করেছে, কিন্তু আমি ধরছিনা ! 
মা মা মা ।  
মা তোমার হাতে আবার সেই  ভাত ভাজি খেতে মন চায় মা ।  
বাবা বাবা  বাবা  ।  
তোমার হাত ধরে আবার সেই ছোট্টোবেলার মতো বাজারে যেতে মন চায় বাবা ।  

এই বয়সে এসেও আমি বাবা-মার কাছে সেই  ছোট্টোটাই রয়ে গেছি। 

আমার বাবা বলতো  ... “আগের দিনের রান্নার টেস্টই ছিল আলাদা ... বাবা আসলে আমার ঠাম্মার কথাই বলছে ! " 

মা  বলে-  ‘ চুলা পুকুরের কৈ মাছের মজাই অন্য রকম ' আসলে ওই দিদিমার রান্নাকেই বুঝাচ্ছে। 

মা  মা  ......
পৃথিবীর সব সন্তানের কাছেই  মায়ের হাতের রান্নাই অমৃত । 

অনেক দিন পর 
ঘটনার পুনরাবৃত্তি ........ 

সেদিন স্কুলে নামিয়ে দেয়ার সময় আমার ছেলে আমাকে ফিসফিস করে বলছে -  
"মাম্মি যে টিফিন দেয় I don't like ’

আমি বললাম- 
“দে দেখি খেয়ে কেমন don't like ? ”

সে মহা আনন্দে স্পাইডারম্যানের টিফিন বক্স খুলে ফ্রেন্সটোস্ট  জাতীয় কিছু একটা দুই আঙ্গুলের চিমটিতে  ধরে আমার হাতে দিয়ে খালি বক্স ব্যাগে ঢুকাতে ঢুকাতে বলল- 

“ স্কুলে এই সব রুটি মুটি আনা নিষেধ করে দিলেই হয় ”

চোখটা ঝাপসা হয়ে উঠে আবার । 
মানষ চোখে জীবনের সিনেমা ভাসতে থাকে। 
জীবনের পুনরাবৃত্তি মনে পরে যায় , সব মনে পরে যায়।  

ছেলের নিষ্পাপ কচি মুখের দিকে তাকিয়ে আমার বুকটা মুচড়ে উঠে। বাবা মা'য়ের কাছে  পৃথিবীতে তার সন্তানের মুখের চেয়ে সুন্দর আর কি আছে !! 

মনেমনে বলি - মিষ্টি মধুর সুখের সংজ্ঞা  জানার বয়স যে এখনো তোর হয়নিরে বাবা সোনা । 

এখানে ছোট্ট করে বলে নেই - 
এই করোনা কালে,  কিছুদিন ধরে দেখতে পাচ্ছি শিল্পী বাচ্চাদের জন্য  পোলাওয়ের চাল ও চিংড়ি আর ডিম বা মুরগি  দিয়ে সকালের  নাস্তা বানাচ্ছে !  আর বলছে - 
বাচ্চারা আজ তোমাদের জন্য ফ্রাইড রাইস নাস্তা !  

ভেসে উঠে মায়ের মায়া ভরা হাসি হাসি মায়া মাখা  মুখ । 
ভিজে আসে আমার চোখ । 
ছেলেকে কাছে টেনে দুই গালে এঁকে দেই চুমু । 

 

ডা. মনোজ কুমার বড়ুয়া