আবরণ
প্রকাশ : 2022-07-15 10:39:07১ | অনলাইন সংস্করণ
নিউজ ডেস্ক
নীলিমা দাস
----------------------
উল্টোরথের আগের দিন ৭৩ বছরের ৩ সহপাঠী অনিক সু হাউজে চায়ের আড্ডায় মশগুল। অনিক সু এর মালিক অনিল মিত্র। তার দোকানে তার সহপাঠীরা মাঝে মাঝে এসে নিজেদের জীবনের গল্প আওড়ায়।
অনিলের পাদুকা ব্যবসা বেশ রমরমা।একচেটিয়া ব্যবসা করে ডুপ্লেক্স বাড়ি, গাড়ি এবং সম্পত্তির পাহাড় গড়েছেন। অনিলের আয়ও যেমন, ব্যয়ও তেমন। দোকান এবং বাড়ি মিলিয়ে ৫ জন সাহায্যকারী আছে। সবার সাথেই তার ব্যবহার ও বনিবনাও ভালো।লক্ষ্মীর বরে ব্যবসা ভালো হওয়ায় বাড়িতে পূজা - পার্বণ ও বেশ ঘটা করে পালন করে। তার পূর্ব পুরুষদের শতবছরের রথযাত্রা পার্বণ এখন তিনিই পালন করেন।তবে পূজা পার্বণেই সীমাবদ্ধ না,তিনি ছেলে মেয়ের লেখাপড়াতেও বেশ যত্নশীল। বড় ছেলে অয়নকে কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে গড়ে তুলেছে, একমাত্র মেয়েকেও রাষ্ট্রবিজ্ঞানে অনার্স - মাস্টার্স করিয়ে বিয়ে দিয়েছেন এবং ছোট ছেলে কৃষি ডিপ্লোমায় অধ্যায়নরত। মেয়েরও ৩ বছরের ১ টি ছেলে আছে।
রজনী শীল। পেশায় নরসুন্দর হওয়ার কথা। কিন্তু সে তাদের জাত পেশা বাদ দিয়ে টিউশন করে ৪ ছেলে ও ২ মেয়েকে একটা পর্যায়ে পৌঁছে দিয়েছেন। বর্তমানে ২ ছেলে এবং এক মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। বড় ছেলের ছোট্ট একটা মুদি দোকান আছে, মেজ ছেলে বেসরকারি একটা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন। বড় মেয়ে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন। অন্য দুই ছেলে এনজিও এবং কোম্পানিতে আছে। রজনী শীল, তার জীবনের বেশির ভাগ সময়ই অসুস্থতায় কাটিয়েছেন। বরং এখন দিব্যি সুস্থ আছেন। বড় ছেলের বউ তো শ্বশুর - শাশুড়ী -দেবর- ননদের প্রানন্তকর সেবাযত্ন করে। বেচারী না করে কোথায় যাবে! বড় ছেলে তার বউকে বলেছে,' আমার মা, বাবা,ভাই,বোনদের সাথে কোন রকম খারাপ ব্যবহার করবে না।' মেজ ছেলের বউ একটু গা বাছিয়ে চললেও জা এর সাথে সম্পর্ক ভালোই।
সুবোধ চ্যাটার্জী। পেশায় পল্লী চিকিৎসক। ৭ মেয়ে, ১ ছেলে। তিনিও ছেলে মেয়েদের সুশিক্ষিত করে বিয়ে দিয়েছেন।এবং তার ছেলে মেয়েরা সবাই চাকুরীরত।৬ মেয়ের পর ছেলের জন্ম।তার ছেলেটি দেখতেও যেমন সুন্দর, আচার ব্যবহারও মার্জিত। নাম সুবল। সমাজসেবা অধিদপ্তরের একটা ভালো পোস্টে আছে।সুবোধ এর সংসারে এখন তেমন খরচ নেই। একটা সময় যখন ঘর ভর্তি লোক ছিল তখন বেশ হিমশিম খেতে হয়েছে তাকে সংসারের লাগাম টেনে ধরতে। এখনো এই বয়সে তিনি দৈনিক ১৫০০-২০০০ টাকা আয় করেন এবং তার সম্পত্তি ও জমিজমা থেকেও বার্ষিক খোরাকের যোগান হয়। সংসারে এখন মাত্র ৬ জন মানুষ।
সুবলের বউ ততটা সুশ্রী নয়।সুবোধ চ্যাটার্জী মধ্যবিত্ত পরিবারের এক শিক্ষকের কন্যার সাথে সুবলের বিয়ে দেন।তিনি কনে দেখতে গিয়ে কনেকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, " তুমি আমার ছেলের স্ত্রী হতে চাও নাকি আমার বাড়ির সদস্য? " প্রশ্ন করে তিনি বলেছেন- যদি আমার বাড়ির সদস্য হতে চাও তাহলে তোমাকে অনেক ঝক্কিঝামেলা পোহাতে হবে। আমার সাত মেয়ে যখন নাতি- নাতনি নিয়ে বাড়িতে বেড়াতে আসবে তখন তাদের আপ্যায়ণ, কর্তব্য, আন্তরিকতা তোমার একারই করতে হবে। আমার কিছু জমিজমা থেকে ধান হয়, তার সুরাহা, সংসারের যাবতীয় কাজ তখন তোমারই করতে হবে।অপরদিকে তুমি যদি আমার ছেলের বউ হও তাহলে কিছুই করতে হবে না। নন্দা খুবই সুন্দর উত্তর দিয়েছিল।বলেছিল- দেখুন প্রতিটি মেয়েই অন্য পরিবারে গিয়ে ঐ পরিবারের সদস্য হয় তার গুণাবলির মাধ্যমে।আমি আমার মায়ের মত একটি পরিবারের প্রিয় সদস্য হতে চাই। সুবোধ চ্যাটার্জী বুঝেছিলেন এই কন্যার শিকড় ভালো। এটা কিছুটা হলেও সত্য, " যে পরিবারে মা ভালো, সেই পরিবারের সন্তানও ভালো হয়ে উঠবে।" তো সুবোধ বাবু নন্দাকেই ছেলের বউ করে নয় তার পরিবারের সদস্য করে এনেছিলেন। নন্দাও এই পরিবারে এসে তার মায়েরই মত শাশুড়ীকে পেয়েছে এবং নন্দার ১০ বছরের বিবাহিত জীবনে ১ ছেলে ও ১ মেয়ে নিয়ে দারুণ চলছে। সেখানে শ্বশুর - শাশুড়ী, ননদ কারোর বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ নেই।
আজও রজনী,সুবোধ এবং অনিল চা পান করতে করতে গল্প করছেন। এক পর্যায়ে সুবোধ, অনিলকে জিজ্ঞেস করলো -
" তোমার ছেলে, অয়ন বুঝি খুব ঠাকুর ভক্ত? "
অনিল আমতা আমতা করে বললো," ঐ আর কী!"
সুবোধ জানালো- অয়ন তো বেশ ঘটা করে উল্টো রথে জগন্নাথের ভোগ দিচ্ছে। আমাকে প্রসাদ এর নিমন্ত্রণ করলো।
তখন, রজনীও বলে উঠলো - হ্যাঁ, সেই নিমন্ত্রণ আমিও পেয়েছি। অয়ন ইঞ্জিনিয়ার হলেও ঠাকুরের প্রতি বেশ শ্রদ্ধা ভক্তি আছে। অয়নের বৌও তো ভালো। অত ধনী পরিবারের মেয়ে, সুশ্রী,তবুও অয়নের পরিবেশ এবং মন বুঝে চলতে পারে।
অনিল সহপাঠীদের এসব কথার তেমন যুতসই উত্তর দিতে পারে না।করাণ সে তো ছেলে ও ছেলের বউয়ের কোন কর্মকাণ্ডের কথা স্পষ্ট জানে না। অয়ন, অয়নের বউ,অনিল এবং অয়নের মা এর মধ্যে এক জটিল দূরত্ব তৈরি হয়েছে। অয়নের মা খুবই নিরীহ এবং কর্মপটু। অপরদিকে অয়নের বউ ভয়ংকর স্বার্থপর। নিজের স্বার্থছাড়া কিছুই বোঝে না। আবার কেউ কিছু বললে লঙ্কাকাণ্ড ঘটাবে। অয়নের মা মান - সম্মানের ভয়ে কিছু ই বলে না। শুধু বলে," তোমাকে বধিবে যে, গোকুলে বাড়িছে সে।"
অনিল ছেলের বউয়ের কান্ডকারখানায় কয়েকবার ছেলেকে বলেছে," আমাদের তোমার দেখতে হবে না। তুমি বউ নিয়ে আলাদা তোমার মতো থাকো।" কিন্তু অয়ন কেন অন্যত্র বাসা নিয়ে থাকে না সেটাও বুঝতে বাকী থাকে না। অয়নের সন্তানকে দেখা শোনা তখন কে করবে বা আলাদা বাসায় কালেভদ্রে কিনা অয়নকে শারীরিক টর্চারও সহ্য করা লাগতে পারে।
অয়নের বউ ধনাঢ্য পরিবারের মেয়ে হলেও মানসিকতা যথেষ্ট লোভী এবং মানসিক প্রতিবন্ধী টাইপের। লোভী এজন্য অয়নের ভায়রার বেশ টাকা আছে, সেজন্য বউ অয়নকে বলেছে, ' টাকা জমিয়ে তার ভগ্নিপতিকে টপকাতে হবে।'বউয়ের কথামতো অয়ন হাত খরচ বাবদ সামান্য টাকা খরচ করে আর সব জমায়। ভাই, বোন, আত্মীয় পরিজন কারোর প্রতি তাদের কোন কর্তব্য আন্তরিকতার বালাই নেই।আর খাওয়া পড়া তো বাপের হোটেল আছেই।আর অয়নের বউ প্রতিবন্ধী এজন্য - সে সংসারের কোন কাজ দেখে না, তার সঙ্গী প্রতিবেশী পান চিবানো,রাস্তায় হাঁটা ষোড়শী মেয়েরা।শুধু দিনের রান্নাটা কোন রকম সেরে যে মোবাইল নিয়ে চারদেয়ালে বন্দি হয়, তাকে সুস্থ মানসিকতা বলা যায় না।অনিলের মেয়ে - নাতি বা ছোট ছেলে বাড়িতে আসলে কী খাবে বা তাদের জন্য কোন কর্তব্য অয়নের বউয়ের মাধ্যমে সাধন হয় না। তবে ভগবানের নামে মালা জপা, একাদশী পালন সেসব সাধন হয় বটে। অথচ অয়নের বিয়ের পর নতুন বউকে রান্না শিখিয়েছে অয়নের বোন পারুল। ঘরের সদস্য যখন ঘরের একটা দুইটা কাজ ছাড়া কোন কাজ দেখে না তখন তাকে সদস্য না বলে কাজের লোক বলাটাও মন্দ না।অনিল এসব কারণে প্রায়ই মনমরা হয়ে থাকে।
সুবোধ বাবু বলে, " আমার ছেলের বউয়ের আবার পূজা পার্বণে বাড়াবাড়ি নেই।" নন্দা আমার ঘরের লক্ষ্মী। আমার মেয়েদের বিয়ে দিয়েও মেয়ের অভাব পূরণ করেছে নন্দা।এইতো রথযাত্রার দিন সুবল অফিসে যাপয়ার আগে বউকে বলে গেছে, ' রথযাত্রায় গেলে মাকে নিয়ে যেও।' নন্দা উত্তরে বলেছে,'চাকাবিহীন যে জীবন্ত রথ আমাদের পৃথিবীতে এনেছে তাঁদেরই সেবা করার সুযোগ পাচ্ছি না।' তা দূর থেকে জগন্নাথের চরণে প্রণাম জানাই।
সত্যি শিক্ষার একটা গুণ আছে বটে।ইসকনের এক প্রভু নন্দাকে একাদশী আর মালা জপ করতে বলেছিল।উত্তরে নন্দা বলেছিল," দিনের মধ্যে মা - বাবাকে ১০ টা ডাক দিতে পারছি না, তা নিয়ম করে ভগবানকে ডাকতে পারবো না গো!"
সুবোধ বাবু বলে,আমি ব্রাহ্মণের ছেলে হলেও যেমন ওসব নিয়ম - কানুনের বেড়াজালে ছিলাম না, হয়তো সেই সূত্রেই ছেলের বউও জুটেছে অমন।সত্যিই তো অচল রথ আর অদৃশ্য ঈশ্বরের থেকে বাস্তব গুরুত্বপূর্ণ। আমরা ক' জনে সেকথা বুঝি!
এবার রজনী বললো,আসলেই মানুষের উপর থেকে দেখে কিছুই বোঝা যায় না। সময়ের সাথে সাথে মানুষের ধারনা, বর্ণ বৈষম্য, কর্মকাণ্ড, পেশা,গন্ডি সবই পাল্টে যাচ্ছে। মূলত মানুষের মনুষ্যত্ববোধই প্রধান। আর ভালো মানুষ কখনো আত্মকেন্দ্রীক হয় না,সবার কথা ভাবে।।
অনিক সু হাউজে ক্রেতাও বাড়লো, সাথে সাথে তিন বন্ধু গল্পেও ইতি টানলো।।