আজ মেহেরপুর মুক্ত দিবস
প্রকাশ : 2022-12-06 10:11:03১ | অনলাইন সংস্করণ
নিউজ ডেস্ক
আজ ৬ ডিসেম্বর, মেহেরপুর মুক্ত দিবস। মুক্তিবাহিনীর প্রবল প্রতিরোধের মুখে দাঁড়াতে না পেরে ৫ ডিসেম্বর রাতারাতি হানাদার বাহিনীরা মেহেরপুর ছেড়ে পালিয়ে যায়। আনন্দ আর উল্লাস করতে করতে সর্ব স্তরের মানুষ রাস্তায় নেমে আসে এই দিন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ডাকে স্বাধীনতার সুতিকাগার মুজিবনগর তথা মেহেরপুরের মানুষ মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। তৎকালীন এসডিও তৌফিক এলাহির সক্রিয় ভূমিকায় আনসার-মুজাহিদদের নিয়ে মুক্তিবাহিনী গড়ে তোলা হয়। ভারতের শিকারপুরে প্রশিক্ষণ শেষে এ বাহিনী মেহেরপুর প্রবেশ করে। একই দিনে মেহেরপুর মুক্ত করার জন্য চারদিক থেকে পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়।
পাক বাহিনী আগেই এ খবর জানতে পেরে ৫ ডিসেম্বর রাতে মেহেরপুর ছেড়ে পালিয়ে যায়। হানাদারবাহিনী চলে যাবার সময় মেহেরপুর ওয়াপদা, দ্বিনদত্ত ব্রীজ সহ গুরত্বপূর্ন স্থাপনাগুলো ধ্বংস করে দেয়। পাকবাহীনি চুয়াডাঙ্গার দিকে পালিয়ে গেলে মেহেরপুরের মুক্তিযোদ্ধারা জয়বাংলা বলতে বলতে শহরে প্রবেশ করে। মুক্ত হয় মেহেরপুর। সংগৃহিত তথ্যমতে, মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকহানাদার বাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন সেলে ধরে নিয়ে গিয়ে অকথ্য নির্যাতন চালাতো। মেহেরপুর সরকারী কলেজ, টেকনিক্যাল স্কুল এন্ড কলেজ ও নাটুদা হাইস্কুলে পাকবাহীনি নিরীহ মানুষকে ধরে নিয়ে বেয়োনেট দিয়ে খুচিয়ে গুলি করে হত্যা করতো। সেসব চিত্র এখনো বুকে ধারন করে চলেছেন মুক্তিযোদ্ধারা।
১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল মুজিবনগরে অস্থায়ী সরকারে শপথ গ্রহণের পর মেহেরপুুর টার্গেটে পরিণত হয় হানাদার বাহিনীর। সে অনুযায়ী ১৮ এপ্রিল দুপুরে পাকিস্থানী হানাদার বাহিনী অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে চুয়াডাঙ্গা থেকে সড়ক পথে মেহেরপুর প্রবেশ করার সময় সদর উপজেলার আমঝুপি গ্রামে নির্মম গণহত্যা চালালে এ অ লের প্রতিরোধ ব্যবস্থা কার্যতঃ ভেঙ্গে পড়ে। ভারতের হৃদয়পুর, বেতাই, শিকারপুর সহ বেশ কয়েটি জায়গায় প্রশিক্ষণ শিবির খোলা হয়। ভারতীয় বাহিনীর তত্বাবধানে যুব সমাজ গেরিলা ও যুদ্ধের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতে থাকে। ১৮ এপ্রিল শত্রæ বাহিনী মেহেরপুরে আসে এবং এক সপ্তাহের মধ্যে মেহেরপুর সরকারী কলেজ, কবি নজরুল শিক্ষা মঞ্জিলসহ তিনটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তাদের শক্তিশালী দূর্গ গড়ে তোলে।
এছাড়াও মেহেরপুরের মহাজনপুরের পাশে চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদা উপজেলার নাটুদা হাইস্কুলে পাক বাহিনীর শক্তিশালী ঘাঁটি ছিল। মে মাসের মাঝামাঝি সময়ে নুরপুর, মানিকনগর ক্যাম্পসহ গোটা মেহেরপুর জেলা পাকবাহিনী পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে নেয়। জুন-জুলাই মাসের দিকে উচ্চতর প্রশিক্ষণ শেষে গেরিলারা মেহেরপুরে ফিরে সেতু কার্লভাট ধবংস এবং টেলিফোন সংযোগ বিছিন্ন করে মাইন পুতে রেখে পাক বাহিনীদের যোগাযোগ এবং খাদ্য সরবারাহে বিপদ সংকুল করে তোলে। আগষ্ট মাসের ২ ও ৩ তারিখে মানিকনগর ক্যাম্প উঠিয়ে মোনাখালিতে এবং কাথুলি ক্যাম্প উঠিয়ে গাংনীর ভাটপাড়াতে স্থাপন করতে বাধ্য হয় পাকবাহিনী।
দীর্ঘ প্রায় ৮ মাস ধরে পাকসেনারা রাজাকার ও পিচ কমিটির সহায়তায় সাধারণ মানুষসহ মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের উপর নির্মম অত্যাচার নির্যাতন ও অগ্নিসংযোগ এবং লুটপাট চালাতে থাকে। পাকসেনারা আমঝুপি, ওয়াপদা মোড়, পিরোজপুর, কাজিপুর, ভাটপাড়া, কোলা সহ বিভিন্ন গ্রামে নৃশংস গণহত্যা চালায়। যেখানেই গণহত্যা সেখানেই বধ্যভূমি রয়েছে। তার মধ্যে মেহেরপুর সরকারি কলেজের উত্তরে বিস্তৃত মাঠ, টেকনিক্যাল স্কুল এন্ড কলেজের ভিতর ও ভাটপাড়ায় বধ্যভূমি অন্যতম। গোটা তিন মাস খলিশাকুন্ডি, গোয়ালগ্রাম ও সাহেবনগর, কাজিপুরসহ বিভিন্ন স্থানে পাকবাহিনীর সাথে যুদ্ধ হয়। অসংখ্য জায়গাতে মুক্তিকামী বাঙালিরা পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিতে থাকে। কয়েকটি স্থানে পাকবাহিনীর সাথে সম্মুখ যুদ্ধে কোনঠাসা হয়ে পড়ে পাকবাহিনী। ৬ ডিসেম্বর সকালে মুক্তিবাহিনীর বিশাল বহর মেহেরপুর শহরে প্রবেশ করে। তার পূর্বেই পাক বাহিনীরা পালিয়ে যায়। হানাদার মুক্ত হয় মেহেরপুর।
কথা হয় মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যাক্ষদর্শি বীর মুক্তিযোদ্ধা নূরুল ইসলাম ও বদরুল আলমের সাথে তারা বলেন, যুদ্ধকালীন পাকহানাদার বাহিনী সাধারণ মানুষদের ধরে শহরের টেকনিক্যাল স্কুল এন্ড কলেজ ও সরকারি কলেজের পিছন এবং তাহের ক্লিনিক পাড়াসহ বিভিন্ন সেলে নিয়ে গিয়ে অকথ্য নির্যাতন চালাতো। ৫ ডিসেম্বর রাতে পাক হানাদার বাহিনী চলে যাবার সময় মেহেরপুরের ওয়াপদা, সদর উপজেলার দ্বীনদত্ত ব্রীজসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ধ্বংস করে দেয়। বীর মুক্তিযোদ্ধা জিল্লুর রহমান ও উমেদীন আলী বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আজ না থাকলেও তার আদর্শ রেখে গেছেন। তার আদর্শ মেনে চললে আজ বাংলাদেশ সোনার দেশ হতো কিন্তু আজ এই দেশ সোনার দেশ নেই। এখনো অনেক গণকবর সংরক্ষন করা হয়নি সেই সব গণকবরগুলো চিহ্নিত করে সংরক্ষন করার পাশাপাশি মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে বৈসম্য দূর করার দাবি জানান তারা।
বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল মালেক বলেন, ৬ ডিসেম্বর যে উল্লাস ছিল সেই উল্লাস আজ আর নেই। নতুন প্রজন্মকে সেই ইতিহাস জানাতে না পারলে এক সময় তারা এই ইতিহাস ভুলে যাবে। ৬ ডিসেম্বর আমাদের মেহেরপুর মুক্ত হয়েছে ঠিকই। কিন্তু আমরা বঙ্গবন্ধুর সেই স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়তে পারিনি আজও। সোনার বাংলাদেশ গড়তে হলে সবাইকে একসাথে কাজ করার আহবান জানান তিনি।