আজ মুন্সিগঞ্জ হানাদার মুক্ত দিবস  

প্রকাশ : 2024-12-11 10:28:33১ |  অনলাইন সংস্করণ

  নিউজ ডেস্ক   

আজ মুন্সিগঞ্জ হানাদার মুক্ত দিবস   

আজ ১১ ডিসেম্বর। ঐতিহাসিক মুন্সিগঞ্জ হানাদার মুক্ত দিবস। একাত্তরের নয় মাস মুন্সিগঞ্জের বিশাল ক্যানভাস ছিল রক্তমাখা। রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ আর বিভীষিকাময় অবরুদ্ধ জীবনের পর ১৯৭১ সালের ১১ ডিসেম্বর হানাদারমুক্ত হয় মুন্সিগঞ্জ।

জেলার বিভিন্ন স্থানে সম্মুখযুদ্ধ আর মুক্তিযোদ্ধাদের একের পর এক সফল অপারেশনের ফলে সরকারি হরগঙ্গা কলেজ ক্যাম্প থেকে ১১ ডিসেম্বর ভোরে হানাদার বাহিনী লেজ গুটিয়ে মুন্সিগঞ্জ শহর ছেড়ে পালায়। গা-ঢাকা দেয় পাকিস্তানি বাহিনীর দোসর রাজাকাররাও।

মুন্সিগঞ্জ জেলায় প্রথম শত্রু মুক্ত হয় টংগিবাড়ী উপজেলা। ১৪ নভেম্বর এই উপেজলা মুক্ত হয়। ১৫ নভেম্বর বিবিসিতে এ সংবাদ প্রচারিত হয়। বিবিসির তথ্য মতে, টংগিবাড়ীই বাংলাদেশে সর্বপ্রথম হানাদার মুক্ত হয়। ১৫ নভেম্বর হানাদার মুক্ত হয় লৌহজং উপজেলা। এই সংবাদও বিবিসি ও আকাশ বাণী থেকে প্রচার করা হয়। ১৭ নভেম্বর শ্রীনগর ও ২০ নভেম্বর সিরাজদিখান শত্রু মুক্ত হয়। গজারিয়া মুক্ত হয় ৯ ডিসেম্বর।

২৬ মার্চ সকালে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণার সংবাদ পান মুন্সিগঞ্জের মুক্তিকামী মানুষ। শহরের প্রাণকেন্দ্র গোয়ালপাড়ায় অবস্থিত মুন্সিগঞ্জ টেলিফোন এক্সচেঞ্জের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর পাঠানো এই নির্দেশ গ্রহণ করেন তৎকালীন মহকুমা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতা মোহাম্মদ হোসেন বাবুল।

সকাল ৯টার দিকে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা প্রয়াত আবুল কাশেম তারা মিয়া শহর জুড়ে মাইকিং করে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণার কথা প্রচার করেন। এই সংবাদ শুনতে পেয়ে মুন্সিগঞ্জের আপামর জনতা দিনভর শহরে বিক্ষোভ করতে থাকেন।

অন্যদিকে, বিক্ষুব্ধ জনতা মুন্সিগঞ্জ থানার সামনে বিক্ষোভ মিছিল করেন। স্থানীয় কয়েকজন যুবক মুন্সিগঞ্জ পুলিশ স্টেশনের স্ট্যান্ডে বাঁধা পাকিস্তানি পতাকা পুড়িয়ে দেন।

সম্ভাব্য শত্রুর মোকাবিলার জন্য ওই দিন দুপুরেই মহকুমা সংগ্রাম পরিষদের নেতারা এবং মুক্তিকামী ছাত্র-যুবক সম্মিলিত ভাবে অস্ত্রের ট্রেজারি লুট করেন।

ট্রেজারি লুণ্ঠনে মুন্সিগঞ্জের তৎকালীন এসডিও জিয়াউদ্দিন এম চৌধুরীর নেপথ্য সমর্থন ছিল। তাই অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের সময় পুলিশের পক্ষ থেকে কোন ধরনের বাধা আসেনি। সংগ্রাম পরিষদের নেতারা ট্রেজারির চারটি তালা ভেঙে ১৬০টি রাইফেল আর বিপুল সংখ্যক গোলা বারুদ লুট করে স্থানীয় ছাত্র-যুবকদের মধ্যে বিতরণ করেন।

এটিই ছিল মুন্সিগঞ্জের মুক্তিপাগল যুবকদের প্রথম বিদ্রোহ। যা পাকিস্তানি হানাদারদের টনক নাড়িয়ে দিয়েছিল। সমবেত ছাত্র- জনতা শ্রীনগর, লৌহজং ও টংগিবাড়ী থানার রাইফেল ও গুলি লুট করে।

সিরাজদিখান থানার ওসি মুজিবর রহমান ও গজারিয়া থানার ওসি সৈয়দ আমীর আলী নিজে থেকেই মুক্তিকামী বিদ্রোহী যুবকদের অস্ত্র দিয়ে দেন।

মুন্সীগঞ্জের হরগঙ্গা কলেজে পাকসেনাদের প্রধান সেনাক্যাম্প স্থাপন করা হয়। বিভিন্ন এলাকা থেকে নিরীহ লোকজনকে ধরে এনে এ ক্যাম্পে রাখা হতো। মার্চ মাসের শেষদিকে পাকসেনারা গজারিয়া থানায় অতর্কিত হামলা করে ৩৬০ জন নিরীহ জনতাকে হত্যা করে। মুন্সীগঞ্জে পাকসেনারা ব্যাপক ধ্বংস ও অগ্নিকাণ্ড ঘটাতে থাকে। মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপস্থিতিতে তাদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয়। মুন্সিগঞ্জ উচ্চবিদ্যালয়ের ছাত্রাবাসের পাশেই তৈরি করা হয় বধ্যভূমি। পরে মুক্তিযোদ্ধারা এক হয়ে মুন্সিগঞ্জ থেকে শতাধিক পাকসেনা গোয়ালী মান্দ্রায় যাওয়ার পথে মুক্তিবাহিনী দ্বারা আক্রান্ত হয়। চারদিক থেকে মুক্তিযোদ্ধারা পাকসেনাদের ওপর আক্রমণ চালায়। প্রায় ৩৮ ঘণ্টাব্যাপী এ যুদ্ধে ৩৫ জন পাকসেনা নিহত হয় এবং সাতজন আÍসমর্পণ করে।

৪ ডিসেম্বরের চূড়ান্ত যুদ্ধের পর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধ ও মিত্র বাহিনীর বিমান বহরের হামলার মুখে পড়ে পাকিস্তানি সেনারা পিছু হটে মুন্সিগঞ্জ শহরের হরগঙ্গা কলেজ ক্যাম্পে এবং ধলেশ্বরীর উত্তর প্রান্তের চরে অবস্থান নেয়। সেখান থেকে তারা বিচ্ছিন্নভাবে ধলেশ্বরী নদী সংলগ্ন নয়াগাঁও এলাকায় মর্টার শেল নিক্ষেপ করতে থাকে। এভাবে তারা মুন্সিগঞ্জ শহর থেকে পিছু হটার কৌশল নেয়। ১০ ডিসেম্বর রাত ৩টার দিকে প্রচণ্ড শীতের ঘন অন্ধকারে পাকিস্তানি বাহিনী মুন্সিগঞ্জে তাদের সুরক্ষিত দূর্গ হরগঙ্গা কলেজ ক্যাম্প থেকে পালিয়ে যায়। ১১ ডিসেম্বর কাকভডাকা ভোরে বিভিন্ন এলাকার মুক্তিযোদ্ধারা রাইফেলের মাথায় স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়ে জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু স্লোগান দিতে দিতে মুন্সিগঞ্জ শহরে প্রবেশ করেন এবং জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন। মুক্তিবাহিনী ও জনতার আনন্দ মিছিলে মুখরিত হয়ে ওঠে মুন্সিগঞ্জ।

যাদের তাজা রক্ত ও জীবনের বিনিময়ে এই অর্জন সেই সকল বীর সেনাদের জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা ও সালাম।