"চিরঞ্জীব চারনকবি মুকুন্দ দাস"

প্রকাশ : 2021-05-19 14:28:46১ |  অনলাইন সংস্করণ

  নিউজ ডেস্ক   

"চিরঞ্জীব চারনকবি মুকুন্দ দাস"

‘ভয় কি মরণে থাকিতে সন্তানে
মাতঙ্গী মেতেছে আজ সমর রঙ্গে।'

 সমগ্র ভারতবর্ষ জুড়েই ব্রিটিশ খেদাও আন্দোলন তুঙ্গে। গান্ধী-নেহেরু কিংবা চিত্তরঞ্জন। ঘরে বসে নেই কেউ। অগ্নিঝরা সেই দিনে গানের ঝুড়ি আর যাত্রাপালা দিয়ে  দেশের শোষিত- বঞ্চিত অসহায় মানুষের মাঝে স্বদেশী চেতনার জাগরণ ঘটাতে সমগ্র বঙ্গদেশ যিনি চষে বেড়িয়েছেন। গান গেয়েই তিনি বৃটিশ সরকারের ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন। তিনি আর কেউ নয় দেশ, মাটি ও মানুষের প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ  চারনকবি মুকুন্দ দাস।

 ১৮৭৮ সালের ২২শে ফেব্রুয়ারি  ঢাকা জেলার বিক্রমপুর পরগণার টঙ্গীবাড়ির বানরী গ্রামে কীর্তিমান এই শিল্পমানবের জন্ম। পিতার নাম গুরুদয়ালদে আর মাতা শ্যামাসুন্দরী দেবী। বাবা কাজ করতেন বরিশালে এক ডেপুটির আদালতে। মুকুন্দ দাসের বাবার দেওয়া নাম ছিল যজ্ঞেশ্বর দে তবে যগা নামেই ডাকতেন সবাই। যজ্ঞেশ্বরের জন্মের পর ঐ গ্রামটি পদ্মায় তলিয়ে গেলে তারা সপরিবারে চলে আসেন বরিশালে। বরিশালের বজ্রমোহন স্কুলে তাঁর শিক্ষা জীবন শুরু। সংসারে অসচ্ছলতার কারনে পড়াশোনা বেশিদূর এগোয়নি।

 চাকরি থেকে অবসর  নিয়ে গুরুদয়াল বরিশালে একটি ছোট মুদি দোকান দিয়েছিলেন। আর এই দোকানটি নিয়েই শুরু হয় মুকুন্দের কর্মজীবন। ছোটবেলা থেকে তাঁর গানের গলা ছিল খুবই মিষ্টি। শুনে শুনেই গান গাইতে পারতেন। বরিশালের তৎকালীন নাজির  বীরেশ্বর গুপ্ত একটি কীর্তনের দল গঠন করেছিলেন। ১৯ বছর বয়সে সেই দলে যোগ দেন যজ্ঞেশ্বর। অল্পদিনের মধ্যেই তার গায়করূপে সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। বৈষ্ণব সন্ন্যাসী রামানন্দ অবধূত যজ্ঞেশ্বরের গলায় হরিসংকীর্তন ও শ্যামাসঙ্গীত শুনে মুগ্ধ হন। এরপর রামানন্দ সাধুর  নিকট  থেকে বৈষ্ণবমন্ত্রে দীক্ষা নেওয়ার পর  যগার নাম হয় মুকুন্দ দাস।

একসময় মুকুন্দ দাস নিজেই একটি র্কীতনের দল গড়ে তোলেন। বিভিন্ন পূজাপার্বনে কীর্তনের এই দল নিয়ে বরিশালের বিভিন্ন স্থানে তাকে  যেতে হতো। এভাবে অনেক কীর্তনীয়া দলের সাথে তার সখ্যতা গড়ে উঠে।

কালীসাধক সনাতন চক্রবর্তী ওরফে সোনা ঠাকুরের প্রেরণায় প্রবল দেশাত্ববোধে উদ্ধুদ্ধ হন মুকুন্দ।দেশের মানুষকে পরাধীনতা ও নানা প্রকার সামাজিক দুর্দশার বিরুদ্ধে সচেতন করার উদ্দেশ্যে এসময় তিনি গান ও যাত্রাপালা রচনায় মনোনিবেশ করেন।১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গকে কেন্দ্র করে বরিশালে ইংরেজবিরোধী বিক্ষোভ দানা বেধে উঠে। মুকুন্দ নিজে এ বিক্ষোভে অংশ নেন এবং একের পর এক গান, কবিতা ও নাটক রচনা করতে থাকেন।

বিপ্লবী ক্ষুদিরামের ফাঁসি হলে মুকুন্দ দাস গান বাঁধেন: ‘হাসি হাসি পরব ফাঁসি/দেখবে জগৎ বাসী/একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি।’
স্বদেশী আন্দোলন বিশেষ করে বিদেশী পন্য বর্জন আন্দোলনে তাঁর বিশেষ ভূমিকা ছিল। ‘বঙ্গনারী রেশমিচুড়ি আর পরো-না’ তাঁর এই গানটি একসময় গ্রামে গ্রামে তীব্র উন্মাদনা জাগিয়েছিল।

গানের জন্য তিনি এত জনপ্রিয় হয়ে উঠেন যে, সারা বরিশালেই দল নিয়ে ঘুরতে হতো তাকে। এরপর বরিশালের হিতৈষী পত্রিকায় লিখতে শুরু করেন মুকুন্দদাস। সেই সময়ে বিভিন্ন দেশবরেণ্য নেতা এমনকি স্বয়ং রবীন্দ্রনাথও তাঁর গান শুনে মুগ্ধ হন।

এভাবেই এক সময় মুকুন্দদাস  বরিশালের অশ্বিনী কুমার দত্তের সংস্পর্শে আসেন এবং তার আগ্রহে মাতৃপূজা নামে একটি নাটক রচনা করেন। জনগণকে ক্ষেপিয়ে তোলার অভিযোগে ইংরেজ সরকার মাতৃপূজা নাটকটি বাজেয়াপ্ত করে। ছিল ধান  গোলাভরা শ্বেত ইঁদুর করলো সারা- মাতৃপূজার এই গানটির জন্য মুকুন্দদাসের  জরিমানা ও  ৩ বছরের কারাদন্ড হয়। মুকুন্দ দাস কারাবাসে থাকাকালীন তার স্ত্রী সুভাষিণী দেবীর মৃত্যু ঘটে।

জেল থেকে মুক্তিলাভের পর মুকুন্দদাস দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ ও সুভাশচন্দ্র বসুর অনুপ্রেরণায় নতুন করে যাত্রার দল গঠন করে পুনরায় পালা রচনায় মনোনিবেশ করেন।১৯১৬ সালে চিত্তরঞ্জন দাশের আমন্ত্রনে কলকাতায় যান তিনি। কলকাতায় থাকাকালে কবি কাজী নজরুল ইসলাম তার সাথে দেখা করেন। কবি  মুকুন্দকে গান গেয়ে শোনান ও নিজের লেখা কয়েকটি বইও উপহার দেন।  

সঙ্গীত ও যাত্রাপালার মাধ্যমে দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে অংশ গ্রহন করেন মুকুন্দদাস। বাংলার জনগণ তাকে চারনকবি আখ্যা দেন। গান করে সারাজীবন সাতশোর মত মেডেল ও বহু পুরস্কার পান তিনি।  তার রচনার মধ্যে আছে- সাধনসঙ্গীত, পল্লীসেবা, ব্রক্ষচারিনী, পথ, সাথী, সমাজ প্রভৃতি।

১৯৩৪ সালের ১৭ মে মুকুন্দদাস তার এক বন্ধুর বাড়িতে নিমন্ত্রন রক্ষা করতে যান। দলকে তালিম দিয়ে পরের দিন গান গাইবার উদ্দেশ্যে বিশ্রাম নিতে  গভীর রাতে বাসায় ফেরেন। কিন্তু ১৮ মে  মুকুন্দদাস পৃথিবীর মায়া ছেড়ে চিরবিশ্রামে চলে যান।